
মৌলবাদের আগ্নেয়গিরি থেকে
বাংলাদেশে ধর্মান্ধ গোষ্ঠীগুলোর একটা রাজনৈতিক উত্থান ঘটছে— সুদূর যুক্তরাষ্ট্র থেকে এই ঘটনা বিশ্বমঞ্চে ফাঁস করেছে নিউ ইয়র্ক টাইমস। অত দূর থেকে এই ছোট্ট দেশের মৌলবাদী হিমশৈলের চূড়া দেখতে পারাটা চাট্টিখানি কথা নয়। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের মানুষের, নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নে বিভোর তরুণ প্রজন্মের এবং রাষ্ট্রের নতুন কর্তাদেরকে সচেতন হতে হবে। বিশেষ করে রাষ্ট্রের কর্তাদের দায়দায়িত্ব অনেক বেশি। ওই প্রতিবেদনটিতে সমালোচকের দোহাই দিয়ে বলা হয়েছে যে, ড. মুহাম্মদ ইউনূস এ গোষ্ঠীটিকে প্রতিরোধের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কঠোর অবস্থান নিচ্ছেন না। সন্দেহ নেই যে, খুবই ভালো ও দরকারি নিউ ইয়র্ক টাইমসের এ প্রতিবেদনটি।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব প্রেক্ষাপটে আরও জরুরি প্রতিবেদন কে লিখবে? আর লিখলেও তাদের সংবাদমাধ্যম ও রাজনীতিবিদরা কি তা গ্রাহ্য করবে? সারা বিশ্বের রাজনৈতিক বয়ান তো তারাই তৈরি করে, অন্যরা তা অনুসরণ করে মাত্র। অন্য বয়ান যে খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই নেই তা নয়, কিন্তু তার কণ্ঠ বেশিদূর পৌঁছায় না। আর অন্য দেশের মানুষ তাদের নিয়ে কী বলল না বলল তাতে যুক্তরাষ্ট্রের কী আসে যায়! তাদের যে কোনো কথাতেই আমাদের আসে যায় অনেক কিছু। বাংলাদেশে যখন মৌলবাদের ডুবন্ত হিমশৈলের চূড়া দৃশ্যমান হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র তখন খ্রিস্টান মৌলবাদের আগ্নেয়গিরির চূড়ায় বসে হাওয়া খাচ্ছে।
তুলসী গ্যাবার্ড যখন ভারতে এসে বাংলাদেশে মৌলবাদের উত্থান নিয়ে তার গভীর উদ্বেগ ও মাথাব্যথার কথা জানালেন, তখন তার চমৎকার বাচনভঙ্গি ও সাহসী কথায় বাংলাদেশে কারও মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। ভারতীয়রা তো রীতিমত পুলকিত হয়েছে এই ভেবে যে, যে রাষ্ট্রে বসে তিনি তার এই মেধার চাকচিক্য দেখালেন তার ক্ষমতায় একটি চরম হিন্দু মৌলবাদী দল। আর তাদের হাতে লেগে আছে গুজরাটে মুসলিম হত্যার রক্ত। বাংলাদেশে মৌলবাদের উত্থানে তুলসী গ্যাবার্ডের উদ্বেগ দেখে আমরাও উদ্বিগ্ন। প্রথম কারণ, তিনি যে কারণে উদ্বিগ্ন সেটি, আর দ্বিতীয় হচ্ছে তার উদ্বেগই আমাদের উদ্বেগের কারণ। হাজার হলেও বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রের দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা সংস্থার তিনি এক চৌকষ নেতা।
তবে এ কথাও ঠিক যে, যে বাড়িতে তিনি মেহমান ওই বাড়িতে বসে তাদের দুর্নাম করা যায় না, কেননা তা মোটেও ভালো দেখায় না। তুলসীকে বাংলাদেশে দাওয়াত দিয়ে তার বসের জন্য কিছু ব্যবসাপাতি গুছিয়ে দেন, তারপর তাকে বাংলাদেশ নিয়ে প্রশ্ন করলে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ছাড়া কিছুই শুনবেন না। তবু তাকে ও তার দেশের নিউ ইয়র্ক টাইমসকে, যাকে তুলসীর বস প্রতিদিন ভুয়া সংবাদমাধ্যম বা ফেক নিউজ বলে গালি দেন, ধন্যবাদ দিতেই হচ্ছে আমাদের চোখ খুলে দেয়ার জন্য।
কিন্তু যারা অন্যের চোখ খুলে দেয়ার কারিশমা দেখায়, তারা কি নিজের দেশে কিছুই দেখে না? মৌলবাদের আগ্নেয়গিরির হৃদপিণ্ডের মধ্যে বসে তারা এ দেশে হিমশৈলের চূড়া দেখে হাপিত্যেশ করছেন। ভালো হোক মন্দ হোক— একটা দীর্ঘমেয়াদী উদ্দেশ্য আছে বৈকি! কিন্তু আমরা যখন তাদের আগ্নেয়গিরির কথাটা ফাঁস করছি তখন কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে তা করছি না। একটাই শুধু চাওয়া— আগে আপনাদের দৈত্যটাকে বোতলে ভরুন, আমাদেরটা পালায়ে সারতে পারবে না। নদীভাঙনের, চঞ্চল ষড়ঋতুর, নকশী কাঁথার, শাহজালাল-শাহপরানের ও বাউলের এই বাংলাদেশে শিকড়বাদের জায়গা কই?
লক্ষণীয়, আজকের দুনিয়ায় জায়নবাদের সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক যুক্তরাষ্ট্র। তাদের সঙ্গে দেড় বছর ধরে ফিলিস্তিনে চালানো ইসরায়েলি গণহত্যায় যুক্তরাজ্যও পৃষ্ঠপোষকতা করে চলেছে। কিন্তু ওই ইহুদি মৌলবাদ নিয়ে ট্রাম্প, ইলন মাস্ক ও তুলসী গ্যাবার্ডের টু শব্দটিও নেই, শুধু তাই নয়, নেতানিয়াহু ডান হাত হিসেবে পেয়েছেন ডনাল্ড ট্রাম্পকে। আর তার বাম হাত হচ্ছে বিখ্যাত নিউ ইয়র্ক টাইমসহ মূলধারার পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম।