
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আলোর রেখা দেখালেন ড. ইউনূস
রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বাংলাদেশ যখন অনেকটা দিশেহারা, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক সাহায্য ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ায় আশ্রিত ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গার খাদ্য, চিকিৎসা এবং অন্যান্য মৌলিক চাহিদা পূরণ নিয়ে সবাই চিন্তিত; ঠিক সে সময়ে থাইল্যান্ডে বিমসটেকের সাইডলাইন মিটিংয়ে মিয়ানমারের জান্তা সরকার ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীকে প্রত্যাবাসনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ সিদ্ধান্তকে আমরা সাধুবাদ জানাই।
প্রফেসর ইউনূসের কোন জাদুর বলে মিয়ানমার সরকার দীর্ঘ ৮ বছর পর এত বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা একসঙ্গে ফেরত নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে, তা নিয়ে মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। নিঃসন্দেহে বিভিন্ন পর্যায়ে প্রফেসর ইউনূসের অবিরাম কূটনৈতিক প্রচেষ্টা, জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের বাংলাদেশে আগমন এবং ড. ইউনূসের অনুরোধে ১ লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে ইফতার করে এ সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক মহলকে এগিয়ে আসার আহ্বান এবং চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে প্রফেসর ইউনূস সাক্ষাৎ করে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মিয়ানমারকে চাপ দেওয়া-সবকিছু মিলে সামগ্রিকভাবে অচলাবস্থায় থাকা রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে কিছুটা আলো দেখা যাচ্ছে।
গত ১৫ মার্চ এক টিভি টকশোতে আমাকে প্রশ্ন করা হয়, প্রফেসর ইউনূস রোহিঙ্গাদের উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘আপনারা আগামী ঈদ আপনাদের দেশে করবেন,’-এ বক্তব্য কতটুকু বাস্তবসম্মত বলে আপনি মনে করেন? উত্তরে বলেছিলাম, ‘জাতিসংঘ মহাসচিবের উপস্থিতিতে লক্ষাধিক রোহিঙ্গার সামনে প্রফেসর ইউনূসের মতো আন্তর্জাতিক হাই-প্রোফাইল ব্যক্তিত্ব শুধু লিপ সার্ভিস দেওয়ার জন্য এ কথা বলবেন, তা কোনোভাবে বিশ্বাসযোগ্য নয়।’ বিস্ময়ের বিষয়, বাংলাদেশের মানুষ এত দ্রুত এ সুখবরটি পাবেন, হয়তো তা ধারণাও করেননি। এটাকে ইউনূস-কারিশমা বললেও অত্যুক্তি হবে না।
কথিত আছে, পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রধানমন্ত্রী নোবেল প্রাইজ পাওয়ার জন্য রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেন। কিন্তু পরবর্তীকালে তাদের ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে তার সরকার সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ সংকট ও সংস্কারের বিষয় থাকা সত্ত্বেও মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে জাতির ওপর থেকে এত বিশাল বোঝা কমানোর প্রক্রিয়া প্রফেসর ইউনূস কীভাবে এত দ্রুত সময়ে করলেন, তা সত্যিই কৌতূহলের বিষয়। সংগত কারণেই প্রশ্ন, হাসিনা সরকার দীর্ঘ সাত বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও পাঠাতে পারল না, সেখানে কেন মিয়ানমার সরকার প্রায় ২ লাখ রোহিঙ্গাকে একসঙ্গে ফেরত নিতে এখন রাজি হলো?
কিছু কারণ মিয়ানমারের এ সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে বলে ধারণা করা যায়-
১. প্রফেসর ইউনূস রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক নেতাদের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যোগাযোগ করে আসছেন। গত মাসে তিনি জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে যৌথভাবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। তারা কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন এবং আগামী রোজার ঈদের আগেই রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা নিয়ে আলোচনা করেন। দুই নেতা এ প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তার প্রয়োজনীয়তা এবং প্রত্যাবর্তনের পর শরণার্থীদের অধিকার নিশ্চিত করা নিয়ে আলোচনা করেন।
২. জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে আলোচনার পর প্রফেসর ইউনূস বেইজিংয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সফরের লক্ষ্য ছিল রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের জন্য চীনের প্রভাব ব্যবহার করা। আলোচনায় বাংলাদেশ ও চীনের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কোন্নয়নের বিষয়টি থাকলেও এতে আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং রোহিঙ্গা সংকটের প্রভাব সম্পর্কেও আলোচনা হয়। এ আলোচনায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে চীনের সমর্থন আহ্বান করা হয়। বঙ্গোপসাগরে চীনের নেভাল এবং কৌশলগত স্বার্থ এবং মিয়ানমারের ওপর তাদের প্রভাব রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াটি এগিয়ে নিতে ব্যবহৃত হয় বলে ধারণা করা যেতে পারে। মিয়ানমারের ওপর চীনের উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে প্রফেসর ইউনূস রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সম্মানজনক প্রত্যাবর্তন সহজতর করার ক্ষেত্রে চীনের ভূমিকার ওপর জোর দিয়েছিলেন।