উৎসবের অর্থনীতি
দুটি বড় উৎসবের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা। এর একটি মুসলমানদের অন্যতম বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর। দ্বিতীয়টি, বাঙালির সর্বজনীন উৎসব বাংলা নববর্ষ। অর্থনীতির বিবেচনায় দুটি উৎসবই অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি বড় অংশ এ ধরনের উৎসবকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়, যা সাধারণভাবে উৎসবের অর্থনীতি নামে পরিচিত।
উৎসব আমাদের অর্থনীতির বড় একটা চালিকা শক্তি। অর্থনৈতিক কর্মচাঞ্চল্য, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশ, সেবা খাতের চাহিদা বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান ইত্যাদি বিষয় নানা উৎসবের সঙ্গে যুক্ত। তাই উৎসবের পরিধি, এর আমেজ, উৎসব ঘিরে আগ্রহ ও উচ্ছ্বাস যত বেশি থাকে, অর্থনীতিতে তত বেশি গতির সঞ্চার হয়। আয়রোজগার বাড়ে কৃষক, শ্রমিক এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের। তাঁদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়লে এমন সব পণ্যের চাহিদা তৈরি হয়, যা বৃহৎ শিল্প খাতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
নানা কারণে এবার উৎসবের অর্থনীতির জন্য ছিল বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। মব ভায়োলেন্স, ছিনতাই ও ডাকাতি বৃদ্ধি; মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়া; রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ছিল আশঙ্কা। এসব কারণে যদি উৎসবের অর্থনীতি ধাক্কা খায়, তাহলে সামগ্রিক অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে কৃষক, শ্রমিক, ক্ষুদ্র–মাঝারি ব্যবসায়ীসহ জনগোষ্ঠীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এর ভুক্তভোগী হবে। তাঁদের আয়রোজগার কমে যাবে, কমবে ক্রয়ক্ষমতা। তাঁদের মধ্যে পণ্য ও সেবার চাহিদা হ্রাস পাবে, যা বৃহৎ শিল্পকেও প্রভাবিত করবে।
উৎসবের অর্থনীতি আসলে কী
উৎসবের অর্থনীতির গুরুত্ব ও এবারের চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে আলোচনা করার এই অর্থনীতির ধরন নিয়ে আরেকটু আলোকপাত করা যেতে পারে। বাংলা একাডেমির ব্যবহারিক বাংলা অভিধান অনুসারে, উৎসব হচ্ছে আনন্দ অনুষ্ঠান, যা অনেকটা ধুমধাম বা জাঁকজমকপূর্ণভাবে উদ্যাপন করা হয়। এসব অনুষ্ঠান বা আনন্দ-আয়োজনে জনগোষ্ঠীর বড় অংশ সম্পৃক্ত থাকে।
উৎসবকে আড়ম্বরের সঙ্গে উদ্যাপনের উদ্দেশ্যে তাঁরা নানা পণ্য ও সেবা কিনে কিনে থাকেন; নিজ নিজ সামর্থ্য অনুসারে যথেষ্ট অর্থ ব্যয় করেন। উৎসব সামনে রেখে উপহার বিতরণ করাও আমাদের সংস্কৃতি ও সামাজিক রীতির অংশ।
উৎসব সামনে রেখে সাধারণত যেসব পণ্য বেশি বেচাকেনা হয় সেগুলোর মধ্যে পোশাক, জুতা, ব্যাগ, প্রসাধনসহ নানা ব্যবহার্য জিনিস যেমন আছে; তেমনই আছে ফ্রিজ, টিভি, কম্পিউটার, মুঠোফোনসহ নানা ইলেকট্রনিক ডিভাইস। খাদ্যপণ্যের মধ্যে আছে মিষ্টি, পিঠা, সেমাই, নুডলস, চটপটি, ফলমূল ইত্যাদি। পিঠা-সেমাই, নুডলস-চটপটি ইত্যাদি তৈরি জন্য আবার প্রয়োজন হয় তেল, চিনি, গুড়, মসলা, নারকেল, লেবু, শসাসহ অসংখ্য শিল্প ও কৃষিপণ্য। উৎসবে এমন শত শত পণ্যের চাহিদা বাড়ে। তাতে স্থানীয় উৎপাদন, পণ্য আমদানি, পাইকারি ও খুচরা বিক্রি ইত্যাদি খাতে বিপুল অর্থ লেনদেন হয়।
উৎসবকে কেন্দ্র করে মানুষের চলাচলও অনেক বেড়ে যায়। তাতে ব্যবহার বাড়ে বিমান, বাস, ট্রেন, লঞ্চ, মাইক্রোবাস, রিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা বা ইজিবাইকসহ নানা বাহনের। কেনাকাটার মূল্য পরিশোধ, সেবা মাশুল, স্বজনদের কাছে অর্থ পাঠানো ইত্যাদির জন্য ব্যাংক, মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস, কার্ড ইত্যাদির ব্যবহারও আগের চেয়ে বাড়ে।
সব মিলিয়ে উৎসব কেন্দ্র করে শিল্পপণ্য, কৃষিপণ্য, আমদানি করা পণ্য ও সেবা খাতে বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়। বাড়তি চাহিদার কারণে পণ্যের জোগানও বাড়ে, যা স্থানীয় উৎপাদন ও আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হয়। পণ্য আমদানি, উৎপাদন ও বিক্রি থেকে সরকার বাড়তি রাজস্ব পেয়ে থাকে। উৎসবের মহাকর্মযজ্ঞের সঙ্গে যুক্ত অর্থনীতির অংশকে উৎসবের অর্থনীতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।