
শাপলায় আলেম ওলামা ও মুসল্লিদের গণহত্যার লোমহর্ষক কাহিনি
শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের সময়টা ছিল সাড়ে ১৭ কোটি মানুষের জন্য এক দুঃস্বপ্ন। এ সাড়ে ১৫ বছরে সব ধরনের অপশাসন এবং কুশাসন করেছেন শেখ হাসিনা। কিন্তু তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াল ও লোমহর্ষক যে চারটি ঘটনা, সেগুলো হলো-পিলখানা ম্যাসাকারে ভারত ও আওয়ামী লীগের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর ৫৭ জন চৌকশ অফিসারসহ ৭৪ জন অফিসারকে হত্যা। দ্বিতীয়ত, ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি মওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায়ের পর সারা দেশে বিক্ষোভ দমনে পুলিশের নির্বিচার গুলিতে ২৫৭ ব্যক্তির শাহাদতবরণ। তৃতীয়ত, ২০১৩ সালের ৫ ও ৬ মে শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে লাখ লাখ মানুষের ওপর পুলিশ, র্যাব ও বিডিআরের হেভি ক্র্যাকডাউন, যার ফলে অসংখ্য আলেম-ওলামা ও মুসল্লি নিহত। সর্বশেষ জুলাই অভ্যুত্থানে দেড় হাজার ছাত্র-জনতার শাহাদতবরণ এবং যৌথবাহিনীর গুলিতে ২৬ হাজার মানুষের আহত হওয়া। এ চারটি গণহত্যার মধ্যে বিভীষিকার দিক থেকে কোনোটিই কারও অংশে কম নয়।
সম্প্রসারণবাদী ভারতের টার্গেট ছিল দ্বিবিধ। প্রথমত, বাংলাদেশে যেন শক্তিশালী কোনো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে না ওঠে। সেজন্য বিডিআর ম্যাসাকার। এ উদ্দেশ্য সাধিত হওয়ার পর তাদের দ্বিতীয় টার্গেট হয় এদেশ থেকে ইসলামি ইমান ও আকিদাকে ধীরে ধীরে মুছে ফেলা। কিন্তু সেই কাজটি এত সহজ ছিল না। কিন্তু এক্ষেত্রে শেখ হাসিনা এবং ভারতের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করে দেয় আমেরিকা ও পাশ্চাত্য দুনিয়ার ইসলামোফোবিয়া। বাংলাদেশে তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের নামে কয়েকজন ব্লগার আল্লাহতায়ালা এবং রাসূলের (সা.) বিরুদ্ধে কুৎসিত অপপ্রচার চালায়। এ অপপ্রচারে এগিয়ে আসে কয়েকজন ব্লগার। এরা হলো রাজীব হায়দার, যে থাবা বাবা নামে ব্লগ লিখত। ব্লগার অভিজিৎ রায়, যে আকাশ মালিক ছদ্মনামে মুক্তমনা ব্লগে লিখত। শেখ হাসিনার শাসন এ চরম ধর্মদ্রোহিতায় নির্বিকার থাকত এবং যারাই এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলত, তাদেরই মৌলবাদী, প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্প্রদায়িক ইত্যাদি তকমা দেওয়া হতো।
এ পটভূমিতে মুসলমানদের ইমান-আকিদা রক্ষায় জন্ম নেয় হেফাজতে ইসলাম নামে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন, যেখানে বেশ কয়েকটি ইসলামি সংগঠন অনেকটা ফেডারেশনের মতো হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে কাজ করা শুরু করে। হেফাজতে ইসলাম শেখ হাসিনা সরকারের কাছে ১৩ দফা দাবি পেশ করে। একটি গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রে দাবি তো উত্থাপিত হতেই পারে। সেই দাবি নিয়ে একটি গণতান্ত্রিক সরকার আপস-আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ পথে সেসব দাবির মিটমাট বা সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে।
এর আগে ওরা পবিত্র ইসলামের বিরুদ্ধে মানুষের মন বিষিয়ে তোলার জন্য জামায়াত নেতাদের কথিত যুদ্ধাপরাধকে ইসলামের সঙ্গে সমার্থক করে। ২০১৩ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে জামায়াত নেতা মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, আবদুল কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামান, মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, আলী আহসান মুজাহিদ, মীর কাসেম আলী, অধ্যাপক গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, আবদুল আলীমসহ অন্তত ২২ জনের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনা হয়। ইসলামের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার এবং সারা দেশে একদলীয় সরকার প্রতিষ্ঠার অসৎ উদ্দেশ্যে শাহবাগে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় স্থাপন করা হয় গণজাগরণ মঞ্চ। এ মঞ্চের আউটার ফেস বানানো হয় ইমরান এইচ সরকার নামক এক ডাক্তারকে। ইমরান এইচ সরকার, লাকী আক্তার প্রমুখের মাধ্যমে কাজ হয়ে গেলে পরবর্তীকালে তাদের পরিত্যক্ত টিস্যু পেপারের মতো ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়।
আজ আমরা আমাদের আলোচনা হেফাজতে ইসলামের গণহত্যার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখব।
২.
আগেই বলেছি, হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবি মেনে নেওয়ার জন্য সরকারকে আলটিমেটাম দেওয়া হয় ২০১৩ সালের ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত। দাবি মানা না হলে ৫ মে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করে হেফাজতে ইসলাম। নির্ধারিত দিনে অর্থাৎ ৫ মে সারা দেশ থেকে লাখ লাখ ওলামা-মাশায়েখ ও মুসল্লি ঢাকা অভিমুখে যাত্রা করেন। জুলাই বিপ্লবের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার মার্চ টু ঢাকা অভিযান ব্লক করার জন্য যেমন ঢাকা মহানগরীর ৬টি প্রবেশমুখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অবস্থান নেয়, অনুরূপ হেফাজতে ইসলামের আলেম-ওলামা এবং মাদ্রাসাছাত্রদের ঢাকায় প্রবেশ বন্ধ করার জন্য মহানগরীর ৬টি পয়েন্টে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অবস্থান নেয়। শাপলা চত্বরে পৌঁছার আগেই রমনা ভবনের উলটো পাশে অবস্থিত আওয়ামী লীগ অফিস এবং বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আগে থেকে মোতায়েন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ এবং ছাত্রলীগের লাঠিয়াল বাহিনী এসব নিরীহ মাওলানা এবং মাদ্রাসাছাত্রদের ওপর নৃশংস হামলা চালায়। ফলে শাপলায় সমাবেশ শুরুর আগেই কয়েকজন হেফাজত কর্মী শাহাদতবরণ করেন। আওয়ামী লীগের ঝটিকা বাহিনী এমন নোংরা রাজনীতির আশ্রয় নেয়, তারা বায়তুল মোকাররমে ইসলামি বইয়ের দোকানে হামলা করে। তারা নিজেরাই পবিত্র কুরআনে আগুন লাগিয়ে সেগুলো হেফাজতের কাণ্ড বলে নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমে প্রচার করে। বায়তুল মোকাররমে সোনার দোকান লুট করে আওয়ামী গুণ্ডা বাহিনী। ইসলামি বইয়ের দোকান, সোনার দোকান ইত্যাদিতে হামলার অভিযোগ হেফাজতের ঘাড়ে চাপিয়ে হেফাজত কর্মীদের গ্রেফতারের হুকুম দেন শেখ হাসিনা। একইসঙ্গে শাপলায় অনুষ্ঠিতব্য সমাবেশ বন্ধ করার জন্য আজকের ভাতের হোটেলের জন্য কুখ্যাত ডিবি হারুন সেদিন উপকমিশনার হিসাবে হেফাজতের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেন।
এ চাপে কোনো কাজ না হওয়ায় হেফাজতের তৎকালীন আমির মরহুম আল্লামা শফিকে জোর করে বিমানে উঠিয়ে চট্টগ্রাম পাঠিয়ে দেন ডিবি হারুন। সারা শহরব্যাপী সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং আওয়ামী লীগের ঠ্যাঙ্গাড়ে বাহিনী ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করে। পথে পথে বাধা, ইস্টক বৃষ্টি, লাঠিপেটাকে উপেক্ষা করে স্রোতের মতো মানুষ শাপলায় জমায়েত হয়। দেখতে দেখতে বিকালের মধ্যেই লক্ষ মানুষের পদভারে প্রকম্পিত হয় শাপলা চত্বর। চত্বরের চতুর্দিক কানায় কানায় পূর্ণ হয়েও চারদিকে জনতার স্রোত উপচে পড়ে।