
পরাজিতদের তৃপ্তির ঢেকুর
পাকিস্তান, আফগানিস্তান, মিয়ানমার, ভুটান, গাম্বিয়াসহ ৪৩টি দেশের নাগরিকদের নানান ক্যাটাগরিতে মার্কিনি ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার সম্ভাব্য তালিকায় বাংলাদেশকে ফেলার আয়োজনটি চরম মার খেয়েছে। এরপরও হাল ছাড়ছে না আয়োজক মহল। সামনে কোনো না কোনো সময় চান্স আসতেও পারে বলে আশা তাদের। সেই আশায় চলছে অন্তহীন চেষ্টা। হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ, তাদের ঘরবাড়ি দখল, জ্বালাও-পোড়াও, মাজারে আক্রমণ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাধা, নারীদের পোশাক নিয়ে কটূক্তি কিংবা পোশাকের কারণে নারীদের হেনস্থা করার মতো কিছু ঘটনাকে রঙিন মোড়কে সামনে এনে বাংলাদেশে উগ্রবাদের উত্থানের কাহিনি প্রচার এজেন্ডা আরও জোরদার করা হয়েছে।
দেশের কয়েক জায়গায় ধর্ষণ, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, ভঙ্গুর অর্থনীতিতে যারা মনে করেছিলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার দেশি-বিদেশি চাপে পড়ছে; এমনকি সামরিক অভ্যুত্থানের গুজবও ছড়ানো হয়েছে। এ রকম সময়েই সফরে আসা জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বাংলাদেশের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, ‘টেকসই এবং ন্যায়সঙ্গত ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য বাংলাদেশ জাতিসংঘের ওপর নির্ভর করতে পারে’। ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ পোস্টেও দেন জাতিসংঘ মহাসচিব। রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে গোলটেবিল বৈঠকে গুতেরেস বলেছেন, এ সময়টা বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই একটি অংশগ্রহণমূলক ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ নির্মাণের এই পথে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও উচিত বাংলাদেশের পক্ষে তাদের প্রত্যাশিত ভূমিকাটি পালন করা।
বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষার অন্যতম বৃহত্তম অবদানকারী দেশ উল্লেখ করে গুতেরেস বিশ্বে সবচেয়ে কঠিন ও বিপজ্জনক পরিবেশে কাজ করা বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের আত্মত্যাগ ও নিষ্ঠার প্রতি শ্রদ্ধা জানান। সফরকালে তার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানও। তারা জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের অবদান, আঞ্চলিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যৎ সহযোগিতার বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। জাতিসংঘ মহাসচিব বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের পেশাদারিত্ব ও দক্ষতার প্রশংসা করেন এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের সক্রিয় ভূমিকার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এ সময় সেনাপ্রধান বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সক্ষমতা, প্রশিক্ষণ ও জাতিসংঘ মিশনে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। জানান, ‘বাংলাদেশ শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং ভবিষ্যতেও এই প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।’
এ রকম একটা নির্ভার সময়েই ভারত সফরে গেছেন গোয়েন্দা প্রধান তুলসী গ্যাবার্ড। সেখানে বাংলাদেশ পরিস্থিতি, বিশেষ করে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন 'গভীর উদ্বিগ্ন' বলে তার দেওয়া সাক্ষাৎকারে এ মহল বেশ আশাবাদী। ইউরেকা-ইউরেকা ভাবভঙ্গি। বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রশাসনের অবস্থান বদলে গেছে-এ মর্মে তাদের প্রচারণা বেশ জোরদার। তুলসীর মূলে জল ঢালা এবং এ সংক্রান্ত চাষাবাদে যারপরনাই ব্যতিব্যস্ত তারা। ঢাকা-দিল্লি দুইখানেই অনেকটা আকস্মিক প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছেন যুক্তরাষ্ট্রের এ গোয়েন্দা প্রধান। তুলসী গ্যাবার্ড বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নির্যাতন ও হত্যা এবং দেশে ইসলামী সন্ত্রাসীদের হুমকি রয়েছে মন্তব্য করে মোটামুটি একটা ভিন্ন আবহ তৈরি করে দিয়েছেন। বাংলাদেশে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সাড়া জাগানো সফর, প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসকে নিয়ে কক্সবাজারে লাখো রোহিঙ্গা শরণার্থীর সঙ্গে ইফতার, ইউনূসের চীন সফরের সময় প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে আসন্ন বিশেষ বৈঠক, ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী নিয়ে প্রকাশিত সংবাদের তীব্র প্রতিবাদ ইত্যাদি মিলিয়ে গোলমেলে অবস্থার মাঝে তারা হালে কিছুটা পানি পেয়েছেন তুলসীর সাক্ষাৎকারটিতে।
মার্কিন সামরিক কর্মকর্তা তুলসী গ্যাবার্ড ২০২৫ সালের শুরু থেকে মার্কিন জাতীয় গোয়েন্দা বিভাগের ৮ম পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এক সময় হাওয়াই রাজ্যে সর্বকনিষ্ঠ আইনপ্রণেতা ছিলেন। ডেমোক্র্যাট দলে ছিলেন ২০০২ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত। পরে রিপাবলিকান পার্টিতে যোগ দেন ২০২৪ সালে। তিন দিনের ভারত সফরে এসে গ্যাবার্ড সে দেশের চ্যানেল এনডিটিভি-কে ১৭ মার্চ সাক্ষাৎকার দেওয়ার পাশাপাশি বার্তা সংস্থা এএনআই-কেও সাক্ষাৎকার দেন। সেখানে তুলসী গ্যাবার্ড বলেন, 'ইসলামি সন্ত্রাসবাদের বিপদ বাংলাদেশকেও প্রভাবিত করছে। তাৎক্ষণিক তুলসীর এসব কথার কড়া প্রতিক্রিয়া দিয়েছে বাংলাদেশ। তুলসী গ্যাবার্ডের মন্তব্য কোনো প্রমাণ বা সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে নয় বলে বিবৃতি দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
বিবৃতিতে ঝাঁঝালো ভাষায় বলা হয়েছে, তুলসীর বিবৃতি বিভ্রান্তিকর এবং বাংলাদেশের ভাবমূর্তি এবং সুনাম ক্ষুণ্ন করার অপপ্রয়াস। এটি একটি দেশকে অন্যায় ও ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। বাংলাদেশ বরাবরই অন্তর্ভুক্তিমূলক ও শান্তিপূর্ণভাবে ধর্ম পালনের ঐতিহ্যের জন্য সুপরিচিত। বাংলাদেশ বিশ্বের আরও অন্যান্য দেশের মতো চরমপন্থার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রতিনিয়ত যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে যৌথভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বিবৃতিতে বলা হয় রাজনৈতিক নেতা ও সুপরিচিত ব্যক্তিদের সংবেদনশীল বিষয়গুলো সম্পর্কে বক্তব্য দেওয়ার আগে প্রকৃত তথ্য যাচাই করা উচিত। তাদের এমন কোনো বক্তব্য দেওয়া উচিত নয় যা ক্ষতিকর ধারণাকে শক্তিশালী করে, ভয় উসকে দেয় এবং সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টির ঝুঁকি বাড়ায়।