
তোমার কথা হেথা কেহ তো বলে না
-গল্পটা এমন—লেনিনকে ঈশ্বরের মুখোমুখি করা হয়েছিল। উদ্দেশ্য, তিনি স্বর্গে যাবেন না নরকে যাবেন, তা নির্ধারণ করা। ঈশ্বরের দূত খুব জোর গলায় বলছিলেন, লেনিন একজন পাপী। তাঁর মতে, লেনিন সারা জীবন ঈশ্বরের বদনাম করেছেন। তাঁর অস্তিত্বের বিষয়ে নিজের সংশয় প্রকাশ করেছেন। সব সময় তাঁকে নিয়ে আজেবাজে কথা বলেছেন। অতএব, নরকই তার প্রকৃত স্থান। সব শুনে দয়ালু ঈশ্বর বললেন, ‘লেনিনকে তার আত্মজবানীর সুযোগ দেওয়া হোক। শোনা যাক সে কী বলে।’
উত্তরে লেনিন বিনীতভাবে নাকি বলেছিলেন, ‘আমি শুধু আপনার অস্তিত্ব নিয়েই সংশয় প্রকাশ করেছি। কারণ আমি কিছুতেই মানতে পারিনি বা বুঝতে পারিনি আপনার হাতে এত কিছু থাকার পরও গরিব মানুষগুলো কেন গরিব থেকে গেল; বুঝিনি, কেন অসাধু আর অসৎ মানুষেরা জীবন উপভোগ করতে পারল; কেন অত্যাচারী শাসক বা শোষকেরা শাস্তি পেল না। আমি বলেছি, গরিব শ্রমজীবী মানুষের কল্যাণের নাম ধর্ম। আমি চেয়েছিলাম সাম্য আর সবার জন্য ন্যায্য বিচার।’ সব শুনে দয়ালু ঈশ্বর চোখ বন্ধ করে বললেন, ‘লেনিন তো একটি বাক্যও বৃথা বলেনি। তার ভেতরে আমার জন্য যে আকুতি বা আমার অবর্তমানে যে অন্যায়-অবিচার, সে তো তার প্রতিবাদ করেছে। লেনিনের জন্য স্বর্গের দুয়ার খুলে দেওয়া হোক।’
গল্পটা গল্পই। কিন্তু আমি ভাবি, বাঙালির মধ্যে নেতাজি সুভাষ বোসকেও হয়তো এভাবে ঈশ্বরের সামনাসামনি করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, ‘কেন তুমি বলেছিলে, তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব? এটা কি খুন চাওয়া নয়?’ সুভাষ বোস কী বলেছিলেন জানি না। তবে ধারণা করি তিনিও বলেছিলেন, ‘যে দেশে মানুষকে স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিতে হয়, যে সমাজে মানুষকে শোষণ আর শাসনে বন্দী রাখা হয়, যে দেশে ভিনদেশের শাসকেরা আমাদের দেশের মানুষকে কথায় কথায় অত্যাচার আর নিপীড়ন করত, সেখানে এর বিকল্প কোথায়? আপনি ন্যায় আর ভালোবাসার প্রতীক। অথচ আমাদের মানুষ সেটা পায়নি বলেই আমি এমন বলতাম।’ সংগত কারণেই ঈশ্বর তাঁকেও নিশ্চয়ই দেবালোকে পাঠাবেন।
আমরা বাঙালিরা ইতিহাস পড়ি, কিন্তু ইতিহাস মানি না। যুগে যুগে পিছিয়ে থাকা বাঙালির জীবনে যে স্বাধীনতার সূর্য উদিত হতে পারে কিংবা মানুষ জান দিয়ে মুক্তির জন্য লড়াই করতে পারে, এটা আমরা ভাবতেও পারিনি। আমাদের স্বপ্নেও এমন কেউ আসতেন না, যিনি আসলে সব মানুষ কাজকর্ম ছেড়ে, নিজের জীবনের মায়া ছেড়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। যেমনটি আল মাহমুদের কবিতায় পাই:
‘তার আহ্বান ছিলো নিশিডাকের শিসতোলা তীব্র বাঁশীর মত।/ প্রতিটি মানুষের রক্তবাহী শিরায় কাঁপন তা বাজত/ নদীগুলো হিসহিস শব্দে অতিকায় সাপের মত ফণা তুলে দাঁড়াতো/ অরণ্যের পাখিরা ডাকাডাকি করে পথ ভুলে উড়ে যেত সমুদ্রের দিকে।...’
তেমন একজন মানুষ পল্লি বাংলার নিভৃত এলাকায় জন্মেছিলেন। বয়স যত বাড়ে, তত তাঁর দীপ্তি বাড়তে থাকে। তাঁর আলোয় বাংলার মাঠ, ঘাট, নদী, নালা এমনকি পাখিও দেখতে শুরু করেছিল নতুন এক ভোর। সেই ভোরের নাম স্বাধীনতা।
উপমহাদেশের দার্শনিক ও ধর্মগুরু স্বামী বিবেকানন্দ। এই তরুণ মানুষটি বলতেন, পৃথিবীর ইতিহাস মানুষের ইতিহাস। কথাটা সহজ মনে হলেও কঠিন। আসলে আমরা ইতিহাসে পড়ি ইতিহাস মানে সম্রাট-রাজা-বাদশাহদের ইতিহাস। যেমন ধরুন, তাজমহল। এটি না বানালেই বা কী লোকসান হতো? কিন্তু আমরা জেনে ধন্য হলাম, এটি দুনিয়ার সপ্তাশ্চর্যের এক আশ্চর্য। এর কারণে উপমহাদেশের নাম জানে মানুষ। আমরা রাজাদের কাহিনি পড়ে বড় হতে হতে বুঝেছিলাম তাঁরা না থাকলে আসলে কোনো ইতিহাস নেই। অথচ যেসব শ্রমিক মাটি খুঁড়ে হরপ্পা বা মহেনজোদারোর অস্তিত্ব বের করে এনেছে, তাদের কেউ চেনে না। ইতিহাস গৌতম বুদ্ধ বা মহাভারতকে বলছে ধর্ম। অথচ একজন শান্তি শান্তি করে বিশ্বকে পরিত্রাণ দিতে চেয়েছিলেন। আর মহাভারতের যুদ্ধ মানেই ভাতৃঘাতী যুদ্ধে না জড়ানোর উপদেশ। যে যুদ্ধ একটি দেশের আশি ভাগ পুরুষকে মেরে ফেলে, যে লড়াইয়ে ভাই ভাইকে খুন করে, যে যুদ্ধে স্বয়ং ভগবানও জড়িয়ে যান, সারথি হয়ে ন্যায়ের জয় নিশ্চিত করতে হয় তাঁকে।