
ধর্ষণ : কারণ ও করণীয়
সাম্প্রতিককালে নারীর প্রতি সহিংসতা, নির্যাতন ও ভায়োলেন্সের এক নতুন অধ্যায়ে যেন প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। গণমাধ্যমগুলোতে দৃষ্টিপাত করলে প্রায় চোখের সামনে ভেসে ওঠে ধর্ষণের নিত্য নতুন খবর। শিশুসহ বিভিন্ন বয়সের নারীরা এ জঘন্য অপরাধের শিকার হচ্ছে। গর্ভবতী নারীকে গণধর্ষণ থেকে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী ধর্ষণ কিংবা ৪ বছরের শিশু ধর্ষণ—রক্ষা পাচ্ছে না কেউই। এমনকি বোনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েও রক্ষা পায়নি ৮ বছরের একটি শিশু। সেখানে তিনি বোনের শ্বশুর কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। শুধু ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি সেই পাষণ্ড, শিশুটিকে হত্যাও করতে চেয়েছিল।
শিশুটি হাসপাতালের আইসিইউতে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়লেও শুরুতে টনক নড়েনি কারোরই। গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর নড়েচড়ে বসেছে সবাই। হয়েছে একটি মামলাও। সেই মামলার এজাহারে শিশুটির মা উল্লেখ করেছেন—বড় মেয়ের স্বামীর সহায়তায় তার বাবা হিটু শেখ শিশুটিকে ধর্ষণ করেন। বিষয়টি হিটুর স্ত্রী ও আরেক ছেলেও জানতেন। ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য তারা শিশুটিকে হত্যার চেষ্টাও করেন।
যে দেশের মেয়েরা নিজ যোগ্যতার ভিত্তিতে দেশবিদেশে গুরুত্বপূর্ণ কাজে সফলতা অর্জন করছে, নারীর ক্ষমতায়নের জন্য যে দেশের সরকার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরস্কারসহ নানা মর্যাদাকর সম্মাননা অর্জন করছে; সে দেশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, গণমাধ্যমে নারী নির্যাতনের অসংখ্য ছবি ভেসে বেড়াবে এটা খুবই দুঃখজনক। যদিও যে খবরগুলো এখানে আসছে তা অনেক কম। ১০০ জন নারী নির্যাতিত হলে সামনে আসছে হয়তো ২০-৩০ জনের খবর।
নারী নির্যাতন বলতে আমরা কেবল শারীরিক নির্যাতনকেই হিসেবে নিচ্ছি, কিন্তু এর বাইরেও আরেক রকমের নির্যাতন আছে যা প্রায় সব পরিবারেই কম বেশি সহ্য করতে হচ্ছে নারীদের। এর নাম হচ্ছে, মানসিক নির্যাতন। বিয়ের আগে ও পরে কম বেশি সব পরিবারেই এই নির্যাতনের ভেতর দিয়ে যেতে হয় মেয়েদের। যদি এসব নির্যাতনকে হিসেবে নেওয়া হয়, তাহলে নারী নির্যাতনের ভাইরাস কতটা যে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, তা কল্পনাও করা যাবে না। এটা দৃশ্যমান কোনো নির্যাতন নয় বলে প্রতিরোধে কোনো ব্যবস্থাও নেই।
নারীর প্রতি মানসিক নির্যাতন প্রতিরোধে কোনো আইন না থাকলেও শারীরিক নির্যাতন প্রতিরোধে বেশ শক্ত আইন আছে দেশে। যদিও তা সত্ত্বেও নারী নির্যাতনের ভাইরাস কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না। ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত গত পাঁচ বছরে দেশে অন্তত ছয় হাজার ৩০৫ জন নারী-শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে তিন হাজার ৪৭১ জন ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু রয়েছে। চলতি বছরের গত দুই মাসে দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছে কমপক্ষে ১০৭ জন। যাদের মধ্যে ৬৬ জন ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু রয়েছে। বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। সংস্থাটি দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুসন্ধান করে এসব তথ্য সংগ্রহ করেছে। এই পরিসংখ্যান কেবল রিপোর্ট হওয়া ঘটনাগুলোর চিত্র তুলে ধরে। বাস্তবে, ধর্ষণের শিকার অনেক শিশু ও তার পরিবার সামাজিক লজ্জা, হুমকি ও বিচারহীনতার কারণে মামলা করতেই পারে না। ফলে প্রকৃত সংখ্যা স্বাভাবিকভাবেই আরও অনেক বেশি হবে।
দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন যে কতটা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে তা বুঝতে পুলিশ সদর দপ্তরের একটি পরিসংখ্যানের দিকে চোখ বুলানো যাক। সেই প্রতিবেদন বলছে—২০১৯ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত ১ লাখ ২৪ হাজার ৬৯৫ জন নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়ে মামলা করেছে। তাদের তথ্য থেকে আরও জানা যায়, ২০১৯ সালে সারা দেশে ২১ হাজার ৭৬৪ জন নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়ে থানায় মামলা করেছে। ২০২০ সালে সেটি আরও বেড়ে যায়। সে বছর ২২ হাজার ৫১৭ জন ভুক্তভোগী মামলা করে। এভাবে ২০২১ সালে ২২ হাজার ১৩৬ জন, ২০২২ সালে ২১ হাজার ৭৬৬ জন, ২০২৩ সালে ১৮ হাজার ৯৪১ জন এবং ২০২৪ সালে ১৭ হাজার ৫৭১ জন মামলা করে। এ ছাড়া চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ১ হাজার ৪৪০ জন মামলা করেছেন। এই প্রতিবেদনগুলো নারী ও শিশু নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে। নিশ্চিত থাকুন, পুরো পরিসংখ্যান এখানেও নেই। এতেই চিত্রটা ভয়াবহ লাগছে। প্রকৃত পরিসংখ্যানটা সামনে আসলে কেমন লাগবে একবার ভাবুন।