
বাইসাইকেল: পরিবেশবান্ধব ও দুর্ঘটনামুক্ত চলাচলের সঙ্গী
বাইসাইকেল পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ বাহন হওয়ার পরও সাইক্লিস্টরা সামাজিকভাবে তেমন মর্যাদা পান না। পথে-ঘাটে বাইসাইকেল চালককে মোটরসাইকেল-বেবি ট্যাক্সি-প্রাইভেটকার চালকরা দেখা মাত্রই বিদ্রুপ করে। ইচ্ছে করে সাইকেলকে চাপা দেওয়ার চেষ্টাও করে। প্রতিবাদ করলে সংঘবদ্ধ হয়ে বাইসাইকেল চালককে হেনস্তা করতে উদ্যত হয় মোটরসাইকেল-চালক, বেবিট্যাক্সি-চালক ও প্রাইভেটকার-চালকরা। কিন্তু কেন এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এর কারণ এসব চালকের কাছে বাইসাইকেল একটি তুচ্ছ বাহন। তাদের মনে হয়, সাইক্লিস্টরা নিতান্ত দরিদ্র ও সমাজের নিম্নশ্রেণির। তাই তারা সাইক্লিস্টকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে দ্বিধা বোধ করেন না। অথচ বাইসাইকেল যেমন পরিবেশবান্ধব, তেমনি সড়ক দুর্ঘটনার কারণও হয় না। কিন্তু এই বাইসাইকেলের জন্যই নিরাপদ লেন তৈরি করা হয়নি। মানিক মিয়া এভিনিউসহ যে দুই একটি সড়কে স্বল্পদৈর্ঘ্যের সাইকেল লেন আছে, সেগুলোও প্রাইভেটকার ও ফুচকাঅলাদের দখলে চলে গেছে। ফলে বাইসাইকেলের জন্য সড়ক আর নিরাপদ থাকেনি।
নিরাপদ বাইসাইকেল লেন প্রসঙ্গে বলার আগে একটু পেছনে ফিরে তাকানো যাক। চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চন ১৯৯৩ সালের ২২ অক্টোবর সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। এই ঘটনার পর ইলিয়াস কাঞ্চন ওই বছরের ১ ডিসেম্বর নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) নামে একটি অরাজনৈতিক সংস্থা গড়ে তোলেন। এই সংস্থার মাধ্যমে তিনি জনগণকে সচেতন করার পাশাপাশি নিরাপদ সড়ক নিশ্চিতে সরকারের ওপর মহলকেও বোঝানোর চেষ্টা করেন। তার এই প্রচেষ্টা দল-মত নির্বিশেষে সবার স্বীকৃতি ও প্রশংসা অর্জন করেছে। তবে, এখনো নিরাপদ সড়ক বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। কেন হয়নি?
এই প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসতে পারে। কারণ, নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করার জন্য যে-সব কাজ সম্পাদন করতে হবে, তার মধ্যে রয়েছে গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষা করা, প্রশিক্ষিত চালক দিয়ে গাড়ি চালানো, চালকদের ডোপটেস্ট করা, সড়কে ট্র্যাফিক পুলিশের নজরদারি বাড়ানো। প্রশিক্ষণ ছাড়া কাউকে ড্রাইভিং লাইসেন্স না দেওয়া, ডোপটেস্ট ছাড়া কাউকে গাড়ি চালাতে না দেওয়া, ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় পেলে আইনি ব্যবস্থা নেয়া, বেপরোয়া গাড়ি চালালে শাস্তির আওতায় আনার মতো অতি জরুরি কাজগুলো সংশ্লিষ্টরা কখনোই করতে রাজি হন না। কারণ এসব কাজ যদি যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়, অসৎ ট্র্যাফিক পুলিশ সদস্যদের মাসোহারা বন্ধ হয়ে যাবে। বখরা পাবেন না নীতিহীন-প্রভাবশালীরা। সমাজে যতক্ষণ অসদুপায় থাকবে, ততক্ষণ অসৎ পুলিশ-প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও প্রভাবশালীরা মাসোহারা পাবেন। অসদুপায় যেদিন বন্ধ হয়ে যাবে, সেদিন এসব ব্যক্তির উপরি পাওনার পথও রুদ্ধ হয়ে যাবে। সুতরাং তারা কখনোই চাইবেন না, সড়ক নিরাপদ হোক। তবু মানবতাবাদীরা আশায় বুক বাঁধেন।
এই নাতিদীর্ঘ গৌরচন্দ্রিকার একটিই উদ্দেশ্য। এই সর্ব-নেতিবাদের যুগে একটি প্রস্তাব করতে চাই। দেশের সড়কগুলো শতভাগ নিরাপদ করার পাশাপাশি সড়কের উভয় পাশে ‘নিরাপদ সাইকেল লেন’ করাও হোক। এ কথা অনস্বীকার্য যে, দেশে জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে যান্ত্রিক বাহনও। কিন্তু তার সঙ্গে সমান হারে বাড়ছে না সড়ক-মহাসড়ক। বরং কোনো কোনো মহাসড়কের ওপর স্থায়ী-অস্থায়ী দোকানপাটের পাশাপাশি গাড়ি পার্কিং চলছে। ফলে সড়ক-মহাসড়কগুলো কোথাও কোথাও সরু হতে হতে প্রায় কানাগলিতে পর্যবসিত হওয়ার উপক্রম। ফলে যে পথ যান্ত্রিক বাহনে ত্রিশ মিনিট থেকে এক ঘণ্টায় পার হওয়ার কথা, যানজটের কবলে পড়ে সেই পথেই কেটে যায় তিন থেকে চার ঘণ্টা। এতে কর্মজীবী মানুষের কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়, কমে যায় উৎপাদন। কিন্তু এই পথটুকু যদি যানজটমুক্ত থাকতো, কিংবা বিশালাকৃতির গাড়ির পরিবর্তে দুই চাকার অযান্ত্রিক বাহনে যাওয়া যেতো, তাহলে মাত্র ত্রিশ মিনিট থেকে এক ঘণ্টায় কর্মস্থলে পৌঁছানো কোনো ব্যাপার ছিল না। বাস্তবেও তাই ঘটছে। প্রাইভেটকার কিংবা মোটরসাইকেলে যে পথে সময় নষ্ট হচ্ছে তিন থেকে চার ঘণ্টা, ওই পথই দুই চাকার অযান্ত্রিক বাইসাইকেলে পার হতে প্রয়োজন হচ্ছে মাত্র পঞ্চাশ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা। অথচ চার লেনের প্রশস্ত সড়ক বলি আর দুই লেনের সড়ক বলি, কোথাও বাইসাইকেলের জন্য কোনো লেন নেই। বাইসাইকেলে চালকরা রাস্তার একেবারে বামপাশ ঘেঁষে কখনো কখনো ফুটপাত দিয়ে পার হতে বাধ্য হচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে দুই ধরনের সমস্যায় পড়ছেন সাইকেলচালকরা। রাস্তার বামপাশ ঘেঁষে চলতে গেলে উল্টোমুখী ও পার্কিং করা যানবাহনকে পাশ কেটে যাওয়ার সময় বাইসাইকেল চালককে কিছুটা মাঝ রাস্তার দিকে যেতে হয়। ঠিক ওই সময় দ্রুতগামী যান্ত্রিক বাহন এসে বাইসাইকেল চাপা কিংবা ধাক্কা দিতে পারে, দেয়ও। এতে দুর্ঘটনার আশঙ্কা বাড়ে। এছাড়া ফুটপাত দিয়ে চলতে গেলে পথচারী ও ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীদের ‘নীতিকথা’সহ কটূক্তির শিকার হতে হয় সাইক্লিস্টদের। এই ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ও দুর্ঘটনা এড়িয়ে চলার স্বার্থে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণে সড়ক-মহাসড়কে ‘বাইসাইকেল লেন’ জরুরি। কারণগুলো মোটামুটি এমন।