
শান্তির রমজানে বাজারে কেন অশান্তি
রহমত, বরকত, মাগফিরাতের মাস রমজানকে অধীর আগ্রহে ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে স্বাগত জানিয়েছে সারা বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমান নারী ও পুরুষ। পবিত্র রমজানের চাঁদ দেখে দোয়া করেছেন : ‘হে আল্লাহ! আমাকে শান্তিময় রমজান দান করুন। রমজানকে আমার জন্য শান্তিময় করুন। রমজানের শান্তিও আমার জন্য কবুল করুন’ (আল্লাহুম্মা সাল্লিমনি লিরমাদান, ওয়া সাল্লিম রামাদানা লি, ওয়া তাসলিমাহু মিন্নি মুতাক্বাব্বিলা)। রাসূলুল্লাহ (সা.) শাবান মাসের ২৯ তারিখ সন্ধ্যায় রমজানের চাঁদের অনুসন্ধান করতেন। এমনকি সাহাবিদের চাঁদ দেখতে বলতেন। রমজানের নতুন চাঁদ দেখলে প্রিয় নবি (সা.) কল্যাণ ও বরকতের দোয়া করতেন। মুসলমানরাও এমন দোয়া করে থাকেন।
শান্তি, কল্যাণ ও সৌভাগ্যের বার্তাবাহী রমজান মাস উপলক্ষ্যে বিশ্বের বহু মুসলিম প্রধান দেশে কারাবন্দিদের মুক্তি দেওয়া হয়েছে। দ্রব্যসামগ্রীর দাম কমানো হয়েছে। সরকার, ব্যবসায়ী সম্প্রদায় ও সমাজের পক্ষ থেকে অনেক ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে, যাতে মানুষ শান্তিতে রোজা পালন ও অন্য আমল নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করতে পারেন এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির পথে এগিয়ে যেতে পারেন।
কিন্তু রমজানের প্রাক্কালে বাংলাদেশে সৃষ্টি হয়েছে, শান্তির বিপরীতধর্মী অশান্তির বাস্তবতা। শুধু এ বছরই নয়, প্রতিবছরই রমজান, ঈদ বা বিভিন্ন উপলক্ষ্যে চলে সাধারণ মানুষের পকেট কাটার মচ্ছব। মজুতদারি করে রোজার আগে বাড়িয়ে দেওয়া হয় দ্রব্যমূল্য। সৃষ্টি করা হয় কৃত্রিম সংকট। রোজাদার মানুষকে ঠেলে দেওয়া হয় অগ্নিময় বাজারের নরককুণ্ডে। রমজানে শান্তির আবহে মানুষ আক্রান্ত হয় অশান্তি ও অসুবিধার বাস্তবতায়। এ বছরও যার ব্যতিক্রম হয়নি অসাধু গোষ্ঠীর কারসাজির কারণে।
যদিও বিগত সরকারের পতনের পর দেশের বিভিন্ন খাতে অসাধু সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য বন্ধ হবে বলেই আশান্বিত ছিল সাধারণ মানুষ, কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে তা বন্ধ হওয়া দূরে থাক, বরং সাময়িক আড়ালে থাকার পর আবারও তারা তৎপর হয়ে উঠছে। রোজায় অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট দানবের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে আমজনতার বিরুদ্ধে। ওয়াকিবহাল মহল, যারা নিত্যবাজার করেন, তারা দেখতে পাচ্ছেন, রমজান সামনে রেখে বাজারে সয়াবিন তেল নিয়ে ফের তেলেসমাতি শুরু হয়েছে। বিষয়টি উদ্বেগজনক এ জন্য যে, পর্যাপ্ত পরিমাণে ভোজ্যতেল আমদানি করা হলেও বাজারে কেন এর প্রভাব নেই? যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা গেছে, ৬ থেকে ৭টি কোম্পানি তেলের বাজার ঘিরে কারসাজি অব্যাহত রেখেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো জোটবদ্ধ হয়ে গত কয়েক মাস ধরে সরবরাহ কমিয়ে তেলের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেছে।
শুধু বোতলজাত সয়াবিন তেল বাজারশূন্য হয়ে পড়ছে বা এর মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে, এমন নয়। দাম বাড়ানো হয়েছে মুরগি, ডিম, মসলা ইত্যাদি ভোগ্যপণ্যেরও। রমজান শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই বাজার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণকারী কতিপয় অসাধু প্রতিষ্ঠান ক্রেতাদের জিম্মি করে ফেলেছে। মূল সরবরাহকারীদের এহেন অপকর্মের ফলে খুচরা বাজারেও পড়েছে দ্রব্য মূল্যবৃদ্ধির কোপ এবং সংকট। এসব দাম বাড়ানো ও সংকট সৃষ্টি যে উদ্দেশ্যমূলক ও কৃত্রিম তার প্রমাণ স্পষ্ট। কারণ, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের গবেষণা তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে ভোজ্যতেলের চাহিদা ২৩ থেকে ২৪ লাখ টন। এর মধ্যে রমজান মাসের চাহিদা ৩ লাখ টন। দেশে ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত আমদানি হয়েছে ১৮ লাখ ৫৭ হাজার ৫৪৮ টন। এছাড়া দেশে উৎপাদিত হয়েছে ২ লাখ ৫০ হাজার টন এবং আমদানি পর্যায়ে পাইপলাইনে রয়েছে ৮ লাখ ১২ হাজার ৫৬৫ টন। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের মূল্য নিম্নমুখী। এ তথ্য থেকেই বোঝা যায়, দেশে ভোজ্যতেলের মূল্যবৃদ্ধি ও সংকটের কোনো প্রকৃত কারণ নেই। অতএব, ভোজ্যতেলের মূল্যবৃদ্ধি ও সংকটের মূলে রয়েছে কিছু প্রতিষ্ঠানের কারসাজি। কারা কোন পর্যায়ে কারসাজি করছে, তা চিহ্নিত করে দায়ীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা না হলে এদের অত্যাচার বাড়তেই থাকবে এবং জনশান্তি বিপন্ন হতেই থাকবে।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, অতীতের স্বৈরাচারী, দুর্নীতিগ্রস্ত ও ফ্যাসিবাদী সরকারের মদদে ও আঁতাতে অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট যে অপকর্ম করেছে, জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী পরিস্থিতিতেও তারা বহাল তবিয়তে সেই একই অপকর্মই করে চলেছে। গত কয়েক বছরের মতো এবারও অসাধু ব্যবসায়ীরা রমজান শুরুর কয়েক মাস আগে থেকেই ছোলা, ভোজ্যতেল, চিনি ইত্যাদি পণ্যের দাম বাড়ানো শুরু করেছে। অতীতে আমরা লক্ষ করেছি, রমজান মাসে যেসব পণ্যের চাহিদা বাড়ে, সেসব পণ্যে শুল্কছাড় দেওয়ার পরও ভোক্তারা এর সুফল পায়নি। এবারও তেমনটি ঘটেছে।