তর্কে সময়, সামর্থ্য ও শক্তির অপচয়

বণিক বার্তা ড. মাহরুফ চৌধুরী প্রকাশিত: ০২ মার্চ ২০২৫, ০৯:৪৯

সমাজ ও রাষ্ট্রের অগ্রগতির ক্ষেত্রে যুক্তিসংগত সংলাপ এবং গঠনমূলক বিতর্কের গুরুত্ব অপরিসীম। ইতিহাস সাক্ষী যুক্তিনির্ভর আলোচনার মাধ্যমেই অনেক জাতি তাদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকটের সমাধান খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমাদের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পরিমণ্ডলে এ প্রথা আজ অপব্যবহারের শিকার। যুক্তিসংগত আলোচনা, পর্যালোচনা ও সমাধানমূলক বিতর্কের পরিবর্তে অহেতুক অতর্ক, কুতর্ক ও অপ্রাসঙ্গিক বিতণ্ডাই অধিক স্থান পাচ্ছে। ফলে দেশের জরুরি রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষাবিষয়ক সমস্যার সমাধানে যে সময়, সামর্থ্য ও শক্তি ব্যয় হওয়া উচিত, তা বরং অপ্রয়োজনীয় মতবিরোধ ও বাহুল্য বাগবিতণ্ডায় নষ্ট হচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষে এ বিতর্ক কেবল বিভ্রান্তিই ছড়াচ্ছে না, বরং জনগণের মাঝে বিভাজন সৃষ্টি করে সমাজ ও রাষ্ট্রকে দুর্বল করে তুলছে। এর সুযোগ নিচ্ছে দুর্বৃত্তরা, যারা জনস্বার্থের চেয়ে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীগত স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়। এতে প্রকৃত সমস্যাগুলোর যথাযথ সমাধান বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং দীর্ঘসূত্রতায় বাস্তবে কোনো পদক্ষেপ নেয়া যাচ্ছে না। ফলে সমাজ ও রাষ্ট্রযন্ত্র ক্রমেই বিশৃঙ্খলা ও অস্থিরতার দিকে ধাবিত হচ্ছে।


সংগত কারণে আলোচনার গভীরে প্রবেশের আগে আমাদের বোঝা দরকার অতর্ক, বিতর্ক ও কুতর্কের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য কী। অতর্ক এমন এক ধরনের আলোচনা, যা পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই বা উদ্দেশ্যহীনভাবে শুরু হয় এবং যার নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য থাকে না। এটি প্রাসঙ্গিকও হতে পারে, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা শুধু সময়ের অপচয় এবং আবেগপ্রসূত মতামতের অযথা বিনিময়ে সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু কুতর্ক এক ধরনের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বাগযুদ্ধ, যেখানে মূল লক্ষ্য থাকে প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করা, সত্য উদ্ঘাটন বা সমস্যার সমাধান নয়। অন্যদিকে বিতর্ক হলো সুসংগঠিত ও যৌক্তিকভাবে উপস্থাপিত দ্বিমত, যা তথ্য-উপাত্ত, তত্ত্ব ও বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে গঠন হয় এবং যা বুদ্ধিবৃত্তিক সমৃদ্ধি ও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। প্লেটোর ‘ডায়ালগ’ ও অ্যারিস্টটলের ‘রেটোরিক’-এ যুক্তির কাঠামো ও সঠিক বিতর্কের আদর্শ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে বিতর্ক যদি সত্যের অনুসন্ধানে পরিচালিত না হয়, তবে তা বিভ্রান্তি ও ভ্রান্ত ধারণা তৈরির মাধ্যম হয়ে ওঠে।


রাষ্ট্র ও সমাজের উন্নতির জন্য যেখানে যৌক্তিক বিতর্ক অপরিহার্য, সেখানে অপ্রয়োজনীয় অতর্ক ও কুতর্ক কেবল বিভ্রান্তিই সৃষ্টি করে না, বরং বিভাজনও বাড়িয়ে তোলে। ফলে নীতিনির্ধারণ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পর্যন্ত সবকিছু একপ্রকার মিথ্যা তথ্য, অপপ্রচার ও আবেগনির্ভর বিভ্রান্তির শিকার হয়। জনশিক্ষার মাধ্যমে যদি মানুষকে যুক্তির চর্চা, গঠনমূলক সংলাপ এবং প্রকৃত সমস্যা সমাধানের পদ্ধতি শেখানো যায়, তবে এ নেতিবাচক প্রবণতাগুলো থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। নৈতিক ও যৌক্তিক বিতর্কের বিপরীতে অতর্ক বা কুতর্কের প্রাধান্য ইতিহাসে বহুবার পুনরাবৃত্ত হয়েছে রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলে। প্রতিবারই দেখা গেছে, যুক্তিকে অবহেলা করে অতর্ক বা কুতর্ককে প্রশ্রয় দিলে একটি জাতির অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হয়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যখনই কোনো সমাজ বা রাষ্ট্র সমস্যার প্রকৃত সমাধান এড়িয়ে অতর্ক বা কুতর্কে লিপ্ত হয়েছে, তখনই তারা পিছিয়ে পড়েছে। গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস যুক্তিনির্ভর প্রশ্ন ও সংলাপের মাধ্যমে সত্যের অনুসন্ধান করতেন, যা ‘সক্রেটিক মেথড’ নামে পরিচিত। তবে গ্রিসের তৎকালীন ক্ষমতাসীনরা তার মুক্তচিন্তাকে হুমকি হিসেবে দেখে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। এর পরিণতিতে গ্রিসে মুক্তচিন্তার পরিসর সংকুচিত হতে থাকে এবং একসময় তারা সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে পতনের দিকে ধাবিত হয়।



ঠিক একইভাবে ইউরোপের অন্ধকার যুগে গির্জার নেতৃত্বাধীন কুতর্কের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও জ্ঞানের বিকাশ দমন করা হয়েছিল। কপর্নিকাস ও গ্যালিলিওর মতো বিজ্ঞানীদের আবিষ্কারগুলো গির্জার কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করেছিল, ফলে তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। ফলে ইউরোপ শতাব্দীর পর শতাব্দী বস্তুনিষ্ঠ জ্ঞানচর্চা ও বিজ্ঞানভিত্তিক অগ্রগতিতে পিছিয়ে পড়ে, যা ইউরোপের ইতিহাসে "অন্ধকার যুগ" (ডার্ক এজ) নামে পরিচিত। তবে রেনেসাঁ এবং বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের মাধ্যমে যুক্তিবাদ ও গবেষণার পুনরুজ্জীবন ঘটে, ফলে ইউরোপ নতুন করে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হয় এবং আধুনিক সভ্যতার ভিত্তি গড়ে ওঠে। এ ঐতিহাসিক শিক্ষা আমাদের শেখায় যে কুতর্ক ও যুক্তিহীন বিতণ্ডা কোনো জাতির উন্নতির পথ নয়; বরং মুক্তবুদ্ধির চর্চা, যৌক্তিক বিশ্লেষণ ও গবেষণাই সত্যিকারের সমাধানের পথ সুগম করে।


বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে যেখানে এখনো অনেক সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান, সেখানে যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি অপরিহার্য। জনশিক্ষার মাধ্যমে যদি সমাজে যুক্তিনির্ভর আলোচনার সংস্কৃতি গড়ে তোলা যায়, তাহলে আমরা অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক ও বিভ্রান্তি এড়িয়ে বাস্তব সমস্যাগুলোর সমাধানে মনোনিবেশ করতে পারব। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যে জাতি সত্য ও জ্ঞানের আলো অনুসরণ করে, সে জাতিই উন্নতির শিখরে পৌঁছায়। আমাদেরও উচিত অহেতুক বিতর্ক ও কুতর্ককে পরিহার করে বাস্তবিক সমস্যার সমাধানে একযোগে কাজ করা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশে বিদ্যমান সমস্যার সমাধানকে অগ্রাধিকার দিতে নিচের বিষয়গুলো বিবেচনায় নেয়া জরুরি।


১. বর্তমান সময়ে আমাদের জাতীয় জীবনে কুতর্কের আধিপত্য সবচেয়ে বেশি লক্ষ করা যায় রাজনৈতিক পরিসরে, যেখানে যৌক্তিক আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে একে অন্যকে দোষারোপ করাই প্রধান লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় নীতিনির্ধারণ, প্রশাসনিক জবাবদিহি ও সমাধানমুখী বিতর্ক থাকা উচিত। অথচ বাস্তবে দেখা যায়, রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের দায় স্বীকার না করে সব সমস্যা প্রতিপক্ষের ওপর চাপিয়ে দেয়, ফলে অর্থনৈতিক মন্দা, বেকারত্ব, দুর্নীতি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা সংকটের মতো বাস্তব সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হয়ে জাতির ঘাড়ে চেপে বসেছে। ইতিহাস বলছে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব যখন সংকট সমাধানের পরিবর্তে অতর্ক ও কুতর্কে ব্যস্ত থাকে, তখন রাষ্ট্র দুর্বল হয়ে পড়ে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রোমান সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণ ছিল রাজনৈতিক অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও অকার্যকর নীতি নির্ধারণ। সাম্প্রতিক বিশ্বেও দেখা যায় যেখানে রাজনৈতিক সংস্কৃতি যুক্তিনির্ভর ও জনমুখী, সেখানে উন্নয়ন দ্রুত হয়; আর যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো কেবল একে অন্যকে দোষারোপ করে, নানা ছলাকলায় ক্ষমতায় যেতে চায়, সেখানে স্থবিরতা ও অরাজকতা সৃষ্টি হয়। একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা, কার্যকর নীতিনির্ধারণ এবং যৌক্তিক বিতর্কের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ। রাজনীতিকে যদি সত্যিকারের জনসেবার হাতিয়ার হিসেবে গড়ে তোলা হয়, তাহলে রাজনৈতিক বিভাজনের পরিবর্তে সমন্বিত ও অন্তর্ভুক্তির প্রচেষ্টায় দেশকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব হবে। এজন্য সুষ্ঠু রাজনীতির চর্চা বাড়াতে জনশিক্ষার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি, যাতে তারা কুতর্ক ও বিভ্রান্তিমূলক প্রচারের ফাঁদে না পড়ে বরং ভোটের সময় প্রার্থী দল বা নির্বাচনের জন্য যুক্তি ও তথ্যনির্ভর বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও