
পাবলিক পার্টি নাকি কিংস পার্টি
গণ-অভ্যুত্থানের সাত মাসের মাথায় এসে নতুন রাজনৈতিক দল করতে যাচ্ছেন ছাত্ররা। ‘ছাত্ররা’ বললাম এ কারণে যে, এখন পর্যন্ত এ দলের নেতা হিসেবে যাঁদের নাম শোনা যাচ্ছে, তাঁরা সবাই গত জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে ছিলেন। দলের নেতৃত্বে কে কে থাকবেন, তা নিয়ে মতবিরোধ কম হয়নি। বাদানুবাদ হয়েছে, অভিমান করে অনেকে সরেও গেছেন। অনেকের নাম এসেছে, সেখান থেকে কাটছাঁট করা হয়েছে। কিন্তু এর কোনো পর্যায়েই তরুণ বা ছাত্র ছাড়া অন্য কারও নাম উচ্চারিত হয়নি একবারের জন্যও। সে হিসেবে বলাই যায় যে নতুন এই সংগঠনটি হতে যাচ্ছে তরুণদের রাজনৈতিক দল।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস অবশ্য এ রকম একটা দলই চেয়েছিলেন। তাঁর মুখে সব সময়ই তরুণদের জয়গান শোনা যায়। তিনি বিভিন্ন জাতীয় বা আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানে প্রায়ই বলেন, ‘তরুণদেরই দায়িত্ব নিতে হবে। তরুণেরাই গড়বে ভবিষ্যতের পৃথিবী।’ কদিন আগে যুক্তরাজ্যের ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের এক পডকাস্টে তিনি নিজে থেকেই জানিয়েছিলেন, আন্দোলনে বিজয়ী তরুণদের তিনি উৎসাহ দিয়েছিলেন নতুন একটা রাজনৈতিক দল করার জন্য। তরুণেরা প্রথমে এ ব্যাপারে দ্বিধায় ছিলেন, কিন্তু ড. ইউনূস তাঁদের যুক্তি দিয়ে বুঝিয়েছিলেন—কেন এমন একটা রাজনৈতিক দলকে দেশের মানুষ পছন্দ করবে। সেই উৎসাহেই কিনা জানি না, তরুণেরা অবশেষে নতুন একটা রাজনৈতিক দল গঠন করতে যাচ্ছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এই দল কতটুকু প্রভাব ফেলতে পারবে? অথবা সামনের জাতীয় নির্বাচনেই-বা কতটুকু কী করতে পারবে?
কিছুদিন ধরেই ক্রেডিট নিয়ে একটা টানাহেঁচড়া চলছিল। এই যে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারকে উৎখাত করা হলো, সেই আন্দোলনের ক্রেডিটটা আসলে কাদের কাছে যাবে—এই নিয়ে তর্ক। বিতর্কটা আসলেই স্বাস্থ্যকর কি না, এই সময়ে এ নিয়ে আলোচনা জাতীয় ঐক্যের জন্য সুখকর কি না, সেই প্রশ্নটিকে গুরুত্ব না দিয়েই বেশ জোরেশোরে চলেছে এগুলো। আসলে এসব চলেছে এ কারণে যে এই সিদ্ধান্তের ওপর ভিত্তি করেই যে যাত্রা শুরু করতে চায় নতুন রাজনৈতিক দলটি। নতুন দলের মূল ভিত্তি এটিই। তারা বলতে চায়, আমরাই পতন ঘটিয়েছি স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের, তাই আমরাই দাবিদার নতুন করে দেশ গড়ার। এমন দাবি যে কোনোই গুরুত্ব বহন করে না, তা নয়।
অবশ্যই তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কিন্তু একই সঙ্গে অন্য অনেক দলের, এমনকি যারা কখনো কোনো দল করেনি, যারা তরুণ বা ছাত্র নয়, যারা গৃহিণী বা শিশু-কিশোর—তাদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল এই আন্দোলনে। পুরো দেশ একত্র হয়ে রুখে না দাঁড়ালে স্বৈরাচারী দানবের পতন ঘটানো সম্ভব হয় না। বাস্তবে সেটাই হয়েছিল এবার। কিন্তু একক ক্রেডিট দাবি করে বসলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক তরুণেরা। আর সেই দাবির ওপর ভিত্তি করেই গঠন করতে যাচ্ছেন তাঁরা নতুন রাজনৈতিক দল। দলের দায়িত্ব নিতে ড. ইউনূস তাঁর উপদেষ্টামণ্ডলীর একজন, নাহিদ ইসলামকে পর্যন্ত পাঠিয়ে দিয়েছেন।
তারপরও বলা হচ্ছে এই দলটিকে কিংস পার্টি বলা যাবে না। কিংস পার্টি নিয়ে কিছুদিন ধরেই বেশ আলোচনা চলছে। কেউ কেউ বলছেন—আসলে কিংস পার্টি বলতে হলে প্রথমেই বলতে হয় বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নাম। কারণ, এই দুটি দলেরই জন্ম হয়েছিল সেই সময়ে কিং বা শাসক জিয়া ও এরশাদের হাত ধরে। এই যুক্তিটিকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। হয়তো এই দুই দলই শুরুতে কিংস পার্টি ছিল। কিন্তু এখন তো আর সেই কিং নেই, এত বছরে দল দুটির শিকড়ও মাটির অনেক গভীরে গেছে, অনেক দূর পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছে, ক্ষমতা থেকে জনতার মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে। তাই ওই দুই দলের সঙ্গে তরুণদের এই দলকে তুলনা করা যাবে না। বিএনপি কিংবা জাতীয় পার্টির কিং এখন পৃথিবী ছেড়ে গেছেন, আর এদের কিং তো বহাল তবিয়তে সিংহাসনে আসীন। তাই যত যুক্তি আর যত বিরক্তিই প্রকাশ করুন না কেন, কিংস পার্টির তকমা অন্তত আগামী নির্বাচন অবধি ঠিকই জড়িয়ে থাকবে নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে থাকা এই দলটির গায়ে।
তারপরও কথা থাকে, নতুন এই দল কতটুকু প্রভাব বিস্তার করতে পারবে আগামী জাতীয় নির্বাচনে? অনেকে বলেন দল গঠনের সময়টা যথাযথ হয়নি। একেবারে শুরুতে করলে যা হতো, এখন আর তা হবে না। এরই মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের ইমেজটা আর আগের পর্যায়ে নেই। তাঁদের কাজকর্ম নিয়ে কিছু বিতর্কও সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি ড. ইউনূসের সরকার নিয়েও মানুষের উৎসাহ আর আগের অবস্থায় আছে বলে মনে হয় না। গত প্রায় সাত মাসে তাঁরা এমন কিছু করতে পারে নাই, যা থেকে সাধারণ মানুষের অনেক উপকার হয়েছে। সংস্কারের নামে অনেক ঢাকঢোল পেটানো হলেও বাস্তবে তা থেকে কিছু পাওয়া যাচ্ছে বলেও মনে হয়নি। ফলে কিংস পার্টি হওয়ার কারণে নতুন এই দলকে বর্তমান সরকারের অনেক ব্যর্থতার দায়ও সঙ্গে নিয়ে পথ চলতে হবে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- রাজনীতিতে নতুন দল