
সম্পাদক, মালিকের জনসংযোগ কর্মকর্তায় পরিণত হবেন না
১৯৭২ সাল থেকে সাংবাদিকতা এবং ১৯৯৩ সাল থেকে সম্পাদক-প্রকাশক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। এতো বছরের অভিজ্ঞতায় গভীর দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, সম্পাদকরা তাদের পদের মর্যাদা বৃদ্ধি, শক্তিশালী করা ও সম্মান বৃদ্ধির পরিবর্তে ঠিক বিপরীত কাজ করছেন। তারা মালিকের জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করে সাংবাদিকতা পেশার সম্মান নষ্ট করছেন, প্রতিষ্ঠানকে কলঙ্কিত করছেন এবং অপমানজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করছেন।
সম্পাদকের দায়িত্ব পালন নিঃসন্দেহে একটি চাকরি। কিন্তু তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এটি জনগণের বিশ্বাসের একটি জায়গা। গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা ও সাফল্য এই বিশ্বাসের ওপরই নির্ভর করে। একজন সম্পাদককে অবশ্যই সাংবাদিকতার মৌলিক নীতি—সত্য, নিরপেক্ষতা, সততা ও পক্ষপাতহীনতা—মেনে চলতে হবে। প্রকাশিত প্রতিটি প্রতিবেদন হতে হবে একাধিক সূত্র থেকে যাচাই করা সত্যের ভিত্তিতে এবং যাদের বিরুদ্ধে লেখা হচ্ছে, তাদের মন্তব্যের সুযোগ দিতে হবে। হ্যাঁ, মালিকের নিজস্ব এজেন্ডা থাকতে পারে এবং কদাচিৎ তারা তা বাস্তবায়ন করতেও পারে। কিন্তু সম্পাদকের দায়িত্ব হলো প্রতিষ্ঠানকে এর অপব্যবহারের হাত থেকে রক্ষা করা।
একজন সম্পাদক হওয়ার পূর্বশর্ত কেবল লেখা, সম্পাদনা, পরিচালনা, নেতৃত্ব দেওয়া, সাংবাদিকদের দিকনির্দেশনা দেওয়া বা অনুসন্ধানী দৃষ্টিভঙ্গি থাকা নয়। এরচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো পর্যাপ্ত আত্মমর্যাদা, ব্যক্তিগত দৃঢ়তা, সাহস ও সম্মানবোধ থাকতে হবে, যাতে তার নিয়ন্ত্রণাধীন গণমাধ্যমকে কখনোই মিথ্যা, মানহানি বা ঘৃণা ছড়ানোর জন্য ব্যবহার করা না হয়। কোনো মালিক সম্পাদককে কিছু প্রকাশ করতে বাধ্য করলে সম্পাদককে দুটি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে—প্রথমত, সেটি অবশ্যই তথ্যভিত্তিক হতে হবে এবং দ্বিতীয়ত, যাদের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন করা হচ্ছে, তাদের জবাব দেওয়ার সুযোগ দিতে হবে। যদি সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়, তাহলে সম্পাদকের উচিত পদত্যাগ করা এবং কীভাবে তিনি সাংবাদিকতাকে অপব্যবহারের হাত থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছিলেন, তা প্রকাশ্যে জানানো। এভাবেই 'সম্পাদকের প্রতিষ্ঠান' গড়ে ওঠে এবং জনমানুষের আস্থা অর্জন করে।
মালিক ও সম্পাদকের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা অস্বাভাবিক নয়। তবে সেটি কেবল 'মতামত' বিভাগে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত। এর প্রভাব কখনোই প্রতিবেদনে পড়া উচিত না। প্রতিবেদন হতে হবে কেবলমাত্র তথ্যভিত্তিক এবং সাংবাদিকতার মৌলিক নীতি মেনে।
একজন মালিক আইনত যেকোনো ব্যবসার মালিক হতে পারেন। কিন্তু, জুতার কারখানা ও ওষুধ কারখানার মালিকানা এক নয়। জুতা কারখানার মালিক ডিজাইন, রং, উপাদান, আকৃতি ইত্যাদির ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারেন। কিন্তু ওষুধ কারখানার ক্ষেত্রে মালিককে অবশ্যই পেশাদার ব্যবস্থাপনার অধীনে কাজ করতে হয় এবং বৈজ্ঞানিক মানদণ্ড অনুযায়ী কারখানা পরিচালনার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হয়। কোনো মালিক কি চিকিৎসককে বলে দিতে পারেন, কোন রোগের জন্য কোন ওষুধ লিখতে হবে? একইভাবে, গণমাধ্যম অবশ্যই পেশাদার সাংবাদিকদের দ্বারাই পরিচালিত হতে হবে। মালিকের উচিত পেশাদারদের—বিশেষ করে সম্পাদকের—সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া, যাতে গণমাধ্যম তথ্যভিত্তিক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে পারে ও নিরপেক্ষভাবে পরিচালিত হতে পারে।
আজকের এই লেখার উদ্দেশ্য হলো মালিক নিয়ন্ত্রিত সাংবাদিকতা বনাম পেশাদার সাংবাদিকতার বিষয়টি উত্থাপন করা এবং জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে সম্পাদকের দায়িত্ব পালন বনাম প্রকৃত পেশাদার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালনের মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরা।
গর্বের সঙ্গে স্মরণ করতে পারি, গণতান্ত্রিক দেশের সংবিধানে কেবলমাত্র দুটি পেশাকে সাংবিধানিক সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে—বিচার বিভাগ ও গণমাধ্যম। কেন? কারণ, অতীত অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে, একটি স্বাধীন বিচার বিভাগ গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে কাজ করে এবং মুক্ত গণমাধ্যম সুশাসনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- মালিক
- সম্পাদক
- সংবাদপত্র
- জনসংযোগ কর্মকর্তা