
ইতিহাসের নানা বাঁকে ফেব্রুয়ারি যেভাবে প্রাসঙ্গিক
ফেব্রুয়ারি বললেই সবার আগে একুশে ফেব্রুয়ারির কথা মনে আসে। তবে রাজনীতি ও ইতিহাস সচেতন মানুষের কাছে ফেব্রুয়ারি মানে শুধু বায়ান্নর অমর একুশে ফেব্রুয়ারি নয়। বরং ইতিহাসের নানা বাঁকে, নানাভাবে ফেব্রুয়ারি মাস হয়ে উঠেছে প্রাসঙ্গিক। ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত এই মাসের ইতিহাস বিপ্লবী আর বিদ্রোহীদের নতুন করে নানা সময়ে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে৷
ফেব্রুয়ারি ছিল আমাদের জন্য যেমন ভাষা আন্দোলনের মাস, তেমনি যুগপৎ এই আন্দোলন আমাদের স্বাধিকারের বীজও বুনে দিয়েছিল। অনিবার্যভাবে যা রূপ নিয়েছিল স্বাধীনতার যুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশেও বারবার ফেব্রুয়ারি ফিরে এসেছে নবরূপে, নব প্রেরণা হয়ে। ফেব্রুয়ারির ইতিহাস আর চেতনাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা গণতন্ত্রের প্রশ্নে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে বারবার বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছে রাজপথে৷
এই ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে সবচেয়ে বড় আন্দোলনটি ঘটেছে ১৯৫২ সালে। সে বছরের একুশে ফেব্রুয়ারি (৮ই ফালগুন) পূর্ব বাংলায়, অর্থাৎ মাত্র বছর চারেক আগে পাকিস্তান নামে যে রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে, তার পূর্বাংশ পূ্র্ব পাকিস্তানে, ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রতিবাদের বিস্ফোরণ হয়েছে।
যদিও এই আন্দোলনের পটভূমি আগেই তৈরি হয়েছিল, পাকিস্তানের জন্মের পরপরেই, উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার বিরোধিতার মধ্যে। পাকিস্তানের যারা সরকারি চাকরি করতেন, এর প্রত্যক্ষ প্রভাব তাদের উপরই পড়ত। তাদের এখানে পাকিস্তানের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হওয়ার একটা আশঙ্কা ছিল। এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের যারা ছাত্র, তাদের অধিকাংশই সেসময় সরকারি চাকরিতে যেত।
সেজন্য তারা এ ঘটনায় দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানাল। তাদের সঙ্গে সেসময় দেশের জনগণও পাকিস্তানি শাসকদের এ অঞ্চলের জনগণের প্রতি যে তাচ্ছিল্যের মনোভাব এবং শোষণ করার অভিপ্রায় ছিল, সেটা বুঝতে পেরে গিয়েছিল। জনগণ বুঝতে পারল যে, কেবল ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে। ব্রিটিশদের পরিবর্তে মুসলিম লীগের শাসন এসেছে। কিন্তু, জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন হয়নি। বৈষম্য দূর হয়নি। এসব মিলিয়ে ছাত্ররা যখন ভাষার জন্য প্রতিবাদ শুরু করল, জনগণও তাদের সঙ্গে যোগ দিল। এবং একুশে ফেব্রুয়ারিতে ছাত্র-জনতার একটা গণঅভ্যুত্থান হল।
ভাষা নিয়ে আন্দোলনের শুরুটা হয়েছিল কিন্তু সরকারি চাকরিতে পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা ভাষাভাষি ছাত্ররা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হয়ে যায় কি না সেই আশঙ্কা থেকে। এটা ছিল বৈষম্য; আঞ্চলিক ও ভাষিক বৈষম্য। আর এই আন্দোলনের ছিল সুদূরপ্রসারী প্রভাব, যা জুলাই অভ্যুত্থানেও দেখতে পাই। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন শুধুমাত্র রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতেই সীমাবদ্ধ থাকল না, কিছুকালের মধ্যে স্বাধিকারের লড়াইয়ে পরিণত হলো এবং গড়াল মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত।
বাঙালি জাতির গৌরব, ঐতিহ্যকে ধর্মীয় আবরণে-আভরণে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা। তারা বলত– ‘তারা উৎকৃষ্ট মুসলমান, আর পূর্ব বাংলার মুসলমানরা নিকৃষ্ট মুসলমান।’ এইভাবে নানাভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা হচ্ছিল। তখন আর যে ভ্রাতৃত্ববোধের কথা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বলছিল না, সেটি ছিল না। ছিল প্রভু এবং মালিকের সম্পর্ক।
ইতিহাসের নানা সময়ে জাতি হিসেবে আমাদের সংগ্রাম, আমাদের জাতীয়তাবোধ, আমাদের ভাষা, আমাদের সঙ্গীত, আমাদের সাহিত্য, আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা প্রমাণ করেছিল বাংলাদেশের মানুষের কোনো অংশেই নিকৃষ্ট নয়। বরং আমরা নিজেদের পৃথিবীকে উদাহরণ হিসেবে দেখাতে পারি। এই যে জাগ্রত জাতীয়তাবোধ, সেটার উন্মেষ ঘটেছিল বায়ান্নতে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন