দ্বিকক্ষের সংসদ করে হিতে বিপরীত হবে না তো?
‘কুইনাইন জ্বর সারাবে বটে, কিন্তু কুইনাইন সারাবে কে?’ এই প্রবাদের সারমর্মটি নির্বাচন সংস্কার কমিটি নিশ্চয়ই আমলে নিয়েই রেখেছে। কেন ‘কুইনাইন’ রূপকটি মনে রাখা দরকার?
অন্তর্বর্তী সরকারের নির্বাচন সংস্কারবিশেষজ্ঞরা মূল রোগটি ধরে ফেলতে প্রশংসনীয় দক্ষতা দেখিয়েছেন। রোগটি হচ্ছে স্বৈরাচারের বারবার ফিরে আসা। পাঁচ-ছয় দশক আগে কলেরা বা যক্ষ্মা যেভাবে বারবার ফিরে আসত, সে রকম। ‘রোগটিকে সমূলে বিনাশ করতে হবে’—এটাই তাঁদের প্রধান করণীয়। এ রোগ থেকে জাতিকে মুক্ত করতে কুইনাইন জরুরি, সেটিও ধরতে পেরেছেন। কুইনাইনটির নাম ‘নির্বাচন সংস্কার’।
নির্বাচন সংস্কারের বিস্তারিত পদ্ধতি-প্রক্রিয়া আমাদের সামনে এখনো আসেনি। যতটুকু এসেছে, তার উদ্দেশ্য পরিষ্কার। স্বৈরশাসন যেন আর কখনোই বাংলাদেশে মহামারি হয়ে উঠতে না পারে। সংস্কার প্রস্তাবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বিজ্ঞজন। গবেষণার কোনোই কমতি রাখেননি নিঃসন্দেহে।
তবু দূর হতে আমাদের কিছু আশঙ্কা-উদ্বেগ, কিছু প্রশ্ন উত্থাপন, কিছু স্পষ্ট ব্যাখ্যা চাওয়া প্রয়োজন। সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞজনদের হয়তো এসবের সবই ঝালাই করা আছে। উত্তরও প্রস্তুত আছে। কিন্তু যদি ভুলক্রমে পর্যালোচনা করা না হয়ে থাকে বা কোনো কারণে খেয়াল না করে থাকেন, তাহলে যেন অবশ্যই পুনরায় বিবেচনায় নেন।
আপাতদৃষ্টে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের বিষয়ে কোনো দলেরই আপত্তি নেই মনে হচ্ছে। কিন্তু তাঁরা কি পর্যালোচনায় রেখেছেন, ব্রিটেনের মতো ওয়েস্টমিনস্টার পদ্ধতির পরীক্ষিত সংসদীয় গণতন্ত্রেও এক দশক ধরে কেন দ্বিকক্ষবিরোধী মতামত প্রবল হয়ে উঠছে। এমনও সম্ভাবনা আছে, ব্রিটেন দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট বিলোপ করবে কয়েক বছরের মধ্যে।
ইতালিতে দ্বিকক্ষ বিলোপের দাবি প্রবল হয়ে উঠেছিল বিগত দশকে। ফলে ইতালিকে নির্বাচনপদ্ধতি সংস্কারের দিকে যেতে হয়। জনগণের বেশির ভাগ কী চায়, তা যাচাই করতে ২০২০ সালের ২০-২২ সেপ্টেম্বর ইতালিতে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ ছিল। জনগণ এক কক্ষের পক্ষে ভোট দেয়। তারা আরও চায়, সংসদের উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষে আসনের সংখ্যা যেন অনেক কমিয়ে আনা হয়। ফলে উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষে আসনসংখ্যা যথাক্রমে ৩১৫ থেকে ২০০ এবং ৬৩০ থেকে ৪০০–তে নামিয়ে আনা হয়।
প্রায়োগিক বিচারে ইতালির সংসদ এ মুহূর্তে মূলত এক কক্ষ সংসদ, কৌশলগতভাবে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট রয়েছে যদিও। সিনেট এখনো টিকে থাকলেও এর ক্ষমতা ও দায়িত্বভার ৯০ শতাংশই কেটেকুটে ফেলা হয়েছে। সিনেট এখন শুধু প্রণীত নতুন আইনগুলো পর্যালোচনা করে এবং মতামত দেয়। হুট করেই একটি প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতিকে বাতিল করে দেওয়া যায় না। ইতালিও অনেকটা পাইলট প্রকল্পের আদলে পরীক্ষামূলকভাবে সিনেটকে জিইয়ে রেখেছে। রাজনীতিবিজ্ঞানীরা জানেন, ক্ষমতা হারিয়ে ইতালির সিনেট একসময় অবশ্যই অকার্যকর হয়ে পড়বে এবং নিয়মতান্ত্রিক উপায়েই ইতালি পুরোপুরি এক কক্ষবিশিষ্ট সংসদ পদ্ধতি গ্রহণ করবে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ