সচিবালয়ে ছাইচাপা আগুন কি জ্বলতেই থাকবে
জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানের সূত্রে প্রশাসনে পরিবর্তন আনার প্রয়োজন হয়। বিগত সরকারের অতি অনুগতদের স্থানে নতুনদের জায়গা করে দেওয়ার উদ্যোগ নেয় সরকার। এই কাজ করতে গিয়ে তৈরি হয় নানামুখী সংকট। প্রায় দেড় যুগ ধরে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের দাবি পূরণ করতে গিয়ে সরকারের নাজেহাল হওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হয়।প্রথম কাজই ছিল বিগত সরকারের প্রতি অতি অনুগতদের সরিয়ে দেওয়া। সেই কাজটি সরকার মোটামুটি সফলভাবেই করতে সক্ষম হয়। কিন্তু ব্যত্যয় ঘটে পদবঞ্চিতদের চাওয়া পূরণ করতে গিয়ে। দীর্ঘ প্রায় দেড় যুগ ধরে যেসব কর্মকর্তা বঞ্চিত ছিলেন তাদের বঞ্চনাটা এতই বেশি যে,তাদের অধিকাংশকেই তিন ধাপ পর্যন্ত পদোন্নতি দিতে হয়। আবার কেউ কেউ হয়তো দশ বছর আগেই চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন,তাদের পদোন্নতিসহ প্রশাসনে ফিরিয়ে এনেছে সরকার। এই ব্যবস্থাকে অনেকেই সহজে মেনে নিতে পারেনি। যেমনি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগকেও পারেনি। কারণ এই ব্যবস্থায় শীর্ষস্থানে যাওয়ার অপেক্ষমানদের পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ে।
অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন গঠন করে সরকার। চলমান প্রশাসন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর লক্ষ্যে সেই কমিশন খসড়া প্রস্তাবও তৈরি করে। কিন্তু কমিশনের প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশের আগেই সরকারি কর্মকর্তারা ফুঁসে ওঠে। সাবেক আমলাদের বেশ কয়েকজনের মতে দীর্ঘস্থায়ী সমস্যাটি বিস্ফোরণের মতো হয়ে গিয়েছে এই কমিশনের অপরিকল্পিত পদক্ষেপের কারণে। তাদের মতে দীর্ঘস্থায়ী সমস্যাকে উস্কে দিয়েছে কমিশনের অচিন্তনীয় পদক্ষেপ। গত ১৭ ডিসেম্বর জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান মুয়ীদ চৌধুরী বলেন পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রশাসন ও ২৫ ক্যাডারে ৫০+৫০ ভাগাভাগি হবে। এবং সচিব হতে হলে তাকে পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে।
স্বাভাবিকভাবে আমলারা এই প্রস্তাবকে সহজভাবে নিতে পারেনি। প্রশাসনে নিয়োজিতদের মধ্যে এমনিতেই ক্ষোভ জমা হয়ে আছে গত সরকার আমলে বঞ্চিত হওয়ার কারণে। এরমধ্যে সংস্কার প্রস্তাবটিতে কারো জন্য সুখবর কারো জন্য দুঃসংবাদ হিসেবে দেখা দেয়। উপদেষ্টার এমন তথ্য প্রকাশের কারণে ‘আন্তঃক্যাডার-বৈষম্য নিরসন পরিষদ’ মাধ্যমে সরকারের ২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তারা এবং প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা মুখোমুখি অবস্থানে চলে যায়। ইতিপূর্বে তাদের মধ্যে রাজনৈতিক কারণে বঞ্চনার যে ক্ষোভ ছিল তার সঙ্গে যুক্ত হয় সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব। দুটি গ্রুপ তখন নিজ নিজ অবস্থানে কঠোর হয়ে পড়ে।
অনাকাঙ্ক্ষিত এবং সরকারি চাকরি বিধিবহির্ভূত আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। তারা সংস্কার কমিশনের প্রধান মুয়ীদ চৌধুরীর পদত্যাগও দাবি করে। পাল্টাপাল্টি অবস্থান ও আন্দোলন তীব্র হওয়ার আলামত স্পষ্ট হওয়ার পর সরকার আন্দোলনকারীদের চাকরি বিধির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাদের কিছুটা দমাতে সফল হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে,ছাই চাপা দিয়ে কি সেই আগুন নেভানো সম্ভব হবে? কর্মকর্তাদের মধ্যে যে ক্ষোভ সেই ২৮ ক্যাডার সৃষ্টির পর থেকে ধীরে ধীরে জমা হয়েছে,সেই ক্ষোভ আইন প্রয়োগে কি শেষ করে দেওয়া যাবে? এই মুহূর্তে বিক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা হয়তো তাদের চাকরি হারানোর ভয়ে চুপসে গেছেন। এমনকি তারা বিক্ষোভ সমাবেশ করার যে কর্মসূচি নিয়েছিলেন সেটিও তড়িঘড়ি করে আলোচনা অনুষ্ঠানে পরিবর্তন করে আনেন। দেখার বিষয়-আইনি ব্যবস্থার আভাস দেখে তারা যে আলোচনা অনুষ্ঠান করেন সেখানেও চাপা ক্ষোভ লুকিয়ে রাখার চেষ্টা দৃশ্যমান হয়। এমন কথা জানা যায় বিভিন্ন মাধ্যমে।
সরকারের ৪ মাস বয়সেই ৫৩৭টি পদোন্নতির ঘটনা ঘটেছে। দাবি করা হয়, এঁরা সবাই বিগত সরকারের রোষানলে পড়ে পদোন্নতি বঞ্চিত ছিলেন। বিশাল সংখ্যক কর্মকর্তার একসময়ের এই পদোন্নতির কারণে প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনা আসবে সেটা স্বাভাবিক। এই পদোন্নতিপ্রাপ্তগণ আবার কেউ ডেপুটি সেক্রেটারি থেকে অতিরিক্ত সচিব হয়েছেন বলেও জানা যায়। ডেপুটি সেক্রেটারি থেকে জাম্প দিয়ে উপরে উঠিয়ে কর্মকর্তার প্রতি সুবিচার করা হলেও তার কর্মদক্ষতা কি জাম্প করতে পেরেছে? নিশ্চয়ই নয়। ফলে কর্মকর্তাদের সেবা দানের ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটবে এটাই স্বাভাবিক।
পদচ্যুত ও বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো আমলাদের স্থানে নতুনদের জায়গা করে দেওয়া হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে এর মাধ্যমে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে তা সহজে নিরসন হওয়ার মতো নয়। এসব কারণেও অস্থিরতা আছে। এবারের সরকার পরিবর্তন হওয়ার পর নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে একটি। তা হচ্ছে,বিগত সরকারের সহযোগী হিসেবে আমলাদের বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে। যা সরকারে থাকা কর্মকর্তাদের মধ্যেও প্রকারান্তরে হুমকি হিসেবে কাজ করছে। কারণ ভবিষ্যতে যখন সরকার পরিবর্তন হবে যদি এর পুনরাবৃত্তি ঘটে?
- ট্যাগ:
- মতামত
- পরিবর্তন
- প্রশাসন
- গণঅভ্যুত্থান