বহুমাত্রিকতার এক অনন্য পুরুষ
গত ৫ জানুয়ারি রোববার দক্ষিণ-এশিয়া উপমহাদেশের অন্যতম খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ, অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক এবং বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য অধ্যাপক আনিসুর রহমান ইহলোক ছেড়ে চলে গেছেন। রোববার দুপুরে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। (ইন্নালিল্লাহি...রাজিউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯১ বছর।
অধ্যাপক আনিসুর রহমান গত ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে লোকচক্ষুর অন্তরালে সেগুনবাগিচার নিজ বাসভবনে নিভৃত জীবনযাপন করেছেন। কালেভদ্রে তার শুভানুধ্যায়ীরা তাকে দেখতে যেতেন। তবে তিনি খুব বেশি কথা বলতেন না। জীবনের শেষ দিকে এসে তিনি বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন। অসুস্থ অবস্থায় তাকে ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই ৫ জানুয়ারি বেলা সোয়া ১টার দিকে তার মৃত্যু হয়।
অধ্যাপক আনিসুর রহমানের জন্ম ১৯৩৩ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। তার গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার কেন্দুয়ায়। তার পিতা হাফিজুর রহমান ছিলেন পুলিশ বিভাগের বড় কর্মকর্তা এবং আইয়ুব খানের মন্ত্রিসভার সদস্য। অধ্যাপক আনিসুর রহমানের পিতা অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। সেই মেধাবী পিতার সন্তান আনিসুর রহমানও ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। তিনি অর্থনীতিতে অনার্স ও মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিলেন। ফুলব্রাইট বৃত্তি নিয়ে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গমন করেন এবং সেখানে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি লাভ করেন। তার পিএইচডি থিসিসের বিষয়বস্তু ছিল আঞ্চলিক বৈষম্যের অর্থনীতি। তার থিসিসটি গাণিতিকভাবে খুবই সমৃদ্ধ ছিল। মাত্র ৬৪টি পৃষ্ঠার মধ্যে তিনি আঞ্চলিক বৈষম্যের কারণ এবং আঞ্চলিক অর্থনীতির বিকাশের গতিসূত্র তুলে ধরেন। তার থিসিস সুপারভাইজার ছিলেন ওয়াসিলি রিয়নটিএফ। লিয়নটিএফ পরবর্তীকালে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন।
১৯৬৩ সালে আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হই, তখন এ বিভাগকে উজ্জ্বল করে রেখেছিলেন ত্রিরত্ন। তারা হলেন অধ্যাপক নূরুল ইসলাম, অধ্যাপক আবু মাহমুদ এবং অধ্যাপক আনিসুর রহমান। তিনজনই ছিলেন হার্ভার্ডের পিএইচডি। বিদ্বৎ সমাজে এরা ছিলেন মশহুর। আমার অর্থনীতি বিভাগে ভর্তির ৩-৪ মাসের মধ্যে প্রফেসর নূরুল ইসলাম করাচিতে অবস্থিত পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিক্সের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ ছেড়ে চলে যান। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রধান ছিলেন। তিনি করাচি চলে যাওয়ায় বিভাগের প্রধানের পদটি খালি হয়। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন ড. ওসমান গণি। ব্যক্তিগত চিন্তাভাবনার দিক থেকে তিনি ছিলেন দক্ষিণপন্থি। বিভাগে জ্যেষ্ঠতার দিক থেকে অধ্যাপক নূরুল ইসলামের পরই ছিল প্রফেসর আবু মাহমুদের স্থান। স্বাভাবিক নিয়মে তারই বিভাগের প্রধান হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ড. ওসমান গণি মার্কস্বাদী অর্থনীতিবিদ আবু মাহমুদকে বিভাগের প্রধান হিসাবে নিয়োগ দিতে চাচ্ছিলেন না। তিনি অধ্যাপক আনিসুর রহমানকে বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু অধ্যাপক আনিসুর রহমান উপাচার্য ড. ওসমান গণির অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বললেন, অধ্যাপক আবু মাহমুদ তার তুলনায় জ্যেষ্ঠ এবং তার শিক্ষকও বটে। নৈতিক বিবেচনায় তিনি প্রফেসর আবু মাহমুদকে ডিঙিয়ে বিভাগের প্রধান হতে পারেন না। শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অধ্যাপক আবু মাহমুদকেই বিভাগের প্রধান পদে নিয়োগ দান করতে বাধ্য হন। এভাবে প্রফেসর আনিসুর রহমান নীতি-নৈতিকতার দিক থেকে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। প্রায় নীতিবোধশূন্য আমাদের সমকালীন সমাজে এমন দৃষ্টান্ত স্থাপনের ঘটনা নেই বললেই চলে।