নদী হত্যার নয়, বাঁচানোর বাংলাদেশ চাই
আমাদের দেশে নদী রক্ষায় কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে তা ভাবার সময় এসেছে। নদী সুরক্ষায় আইনি কাঠামো কীরূপ, সরকারি উদ্যোগগুলো কী পরিমাণ, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা আছে কিনা সেগুলোর পরিষ্কার ধারণাও জরুরি।
দেশের ছোট-মাঝারি-বড় নদী সবগুলোই রক্ষা করতে হবে। সব নদীরই সমান গুরুত্ব না হলেও কোনো নদীকে বাতিল করার সুযোগ নেই। নদী সুরক্ষায় আমাদের দেশীয় আইন বেশ শক্ত। আইন প্রয়োগের অভাবেও নদী মানুষের পেটের ভেতরে চলে যাচ্ছে।
আমি সরেজমিন নদীবিষয়ক কাজ করি প্রায় পনেরো বছর ধরে। এই অভিজ্ঞতা পনেরো বছরের হলেও অভিজ্ঞজনদের নিকট থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান, বই ঘেঁটে যা দেখেছি তাতে বোঝা যায়, নদী সুরক্ষায় অর্ধশতাধিক বছরে দেশ এগোতে পারেনি।
নদীর অবৈধ দখলদারদের পরম যত্নে রাখা হয়। নদীবিষয়ক অপরাধে সংশ্লিষ্টদের শাস্তি দিতে তেমনটা দেখা যায় না। বরং যে কর্মীরা স্বেচ্ছায় নদী সুরক্ষায় কাজ করতে আসেন তাদের দখলদার এবং প্রশাসন মিলে হেনস্থা করার ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে।
অর্ধশতাধিক বছরে ভূমি আইন, পানি আইন, জলমহাল ব্যবস্থাপনা আইনসহ যত আইন হয়েছে তার কোনোটি নদী সুরক্ষার বিপরীতে নয়। তারপরও দেশে এমন একটি নদীর কথাও জোর দিয়ে বলা যায় না, যে নদীটি নিরাপদ আছে কিংবা যে নদীর ভবিষ্যৎ ঠিকঠাক আছে।
ব্রিটিশ শাসনামলে ভূমি জরিপ হয়েছে। সিএস নামে যে জরিপ হয়েছে সেই জরিপটি অনেক গ্রহণযোগ্য। কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও এরচেয়ে আর ভালো কোনো জরিপ আমাদের কাছে নেই। এই জরিপের মাধ্যমে যেগুলো নদী-খাল-বিল-জলাশয় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে সেগুলোর শ্রেণি পরিবর্তনের যেমন সুযোগ নেই তেমনি এগুলোর মালিক ব্যক্তি হওয়ার আইনগত ভিত্তি নেই।
১৯৫০ সালের প্রজাস্বত্ব আইন থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত যত আইন-বিধি তৈরি করা হয়েছে তার কোনোটি নদীর দখল-দূষণ তথা নদীর ক্ষতি করার বৈধতা দেয় না। এমনকি সাংবিধানিকভাবে নদী রক্ষার কথায় বলা হয়েছে। সংবিধান-আইনের আলোকে আদালতও নদী সুরক্ষায় তাগিদ দিয়ে রায় প্রকাশ করেছে। তারপরও নদীর ক্ষতি হচ্ছে প্রকাশ্যে।
দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে অস্বাভাবিক হারে। জনপ্রয়োজনে আমাদের দেশে সড়কপথ, রেলপথ তৈরি করা হয়েছে। সে সময়ে একবারও ভাবা হয়নি নদীর কথা। আবার যেসব স্থানে সেতু তৈরি করা হয়েছে সেগুলো প্রায় সবক্ষেত্রেই নদীর প্রকৃত মাপের চেয়ে ছোট। ফলে সেই সেতুগুলোও নদীর ভীষণ ক্ষতি করছে।
আমাদের দেশে অনেক স্থানে নদীর ওপর দিয়ে আড়াআড়ি সড়ক এমনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে যেখানে কোনো সেতু দেওয়াই হয়নি। নদীর সর্বনাশ করাও বন্ধ হয়নি। যে সর্বনাশ থেকে নদীগুলো রক্ষা করা সম্ভব তা করার তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তবে নদী সুরক্ষার দাবিতে সামাজিক সচেতনতা কিছুটা বেড়েছে। যদিও প্রয়োজনের তুলনায় তাও যৎসামান্য।
নদীগুলো প্রধানত দেখভাল করার কথা প্রশাসন ক্যাডারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। তাদের কাজের পরিধি এতটাই বেশি যে তাদের পক্ষে আলাদা করে নদীর প্রতি মনোযোগ দেওয়া কঠিন। ফলে কোনো কোনো জেলাপ্রশাসক নদীর প্রতি আন্তরিক হলেও নদী রক্ষা করাটা কেবল স্বপ্নের মধ্যেই থাকে।