
ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনাকারী হোক আগামী জলবায়ু সম্মেলন
বন্যার ভয়াবহতা বাড়ছে, হঠাৎ বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে। শীত কখনো বাড়ছে আবার কখনোবা কমছে, পরিচিত ঋতুগুলোকে চেনা এখন অনেকটাই কঠিন। ডেঙ্গুসহ অনেক রোগের প্রকোপ বাড়ছে, নতুন নতুন এলাকা খরার কবলে আক্রান্ত হচ্ছে। কৃষি-প্রাণিকুল ও সার্বিকভাবে জীববৈচিত্র্য বিনষ্ট হচ্ছে। এছাড়াও তাপপ্রবাহ ও বায়ু দূষণের কারণে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হওয়াসহ নানামুখী চাপে ভারাক্রান্ত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ তালিকার সপ্তম অবস্থানের দেশ বাংলাদেশ। ওয়ার্ল্ড ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স-এর সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ীও, পৃথিবীর যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি জলবায়ু ঝুঁকিতে রয়েছে, তার মাঝে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষ দশে।
প্রসঙ্গত, বৈশ্বিক বিভিন্ন জলবায়ু সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সাল ছিল বিশ্বের মানব ইতিহাসের সবচেয়ে উষ্ণ বছর। ২০২৪ সালে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যেমন টানা ও দীর্ঘ তাপপ্রবাহ ও খরা পরিলক্ষিত হয়েছে, তেমনি নানা দেশে হয়েছে বিধ্বংসী ও ব্যাপক বন্যা। এর বাইরে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতার অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি, বিস্তীর্ণ এলাকা ডুবে যাওয়া, উৎপাদন কম হওয়ায় খাদ্য ঘাটতি, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, ভয়াবহ ভূমিকম্প, তাপমাত্রা বৃদ্ধিসহ ভয়ানক সব অশনিসংকেত বাংলাদেশের জনগণের সামনে অপেক্ষা করছে। বৈশ্বিক গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনে বাংলাদেশের অবদান মাত্র ০.৪ শতাংশ হলেও দেশটি চরম ক্ষতির শিকার। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় ক্ষতিপূরণের দাবিতে সোচ্চার।
কিন্তু ক্ষতিপূরণের দাবিই কি একমাত্র ও যথেষ্ট? বাংলাদেশ কি শুধু ক্ষতিপূরণ আদায় করার দাবি জানানোরই সক্ষমতা রাখে? জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার ক্ষেত্রে গুরুত্ব ও কাজের আঙ্গিক বিচারে কৌশলগত কি কোনো পরিবর্তন আনার প্রয়োজন আছে? আমরা আগে নিজেরা বাঁচব, নাকি একইসঙ্গে বিশ্বকেও বাঁচাব? গণতন্ত্র, রাজনীতি ও সুশাসনসহ বাংলাদেশের সামনে এখন মৌলিক অনেক ইস্যু— এর মধ্যে জলবায়ু ইস্যু কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ, কতটা গুরুত্ব দেওয়া উচিত আসলেও? এই প্রশ্নগুলো এখন বাংলাদেশের সামনে! একই ধরনের প্রশ্ন বিশ্বের বিশেষভাবে গরিব ও মধ্যবিত্তের অন্যান্য দেশগুলোও নিজেরা নিজেদেরকে করতে পারে কিংবা তাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে।
সম্প্রতি জাতিসংঘের জলবায়ু বিষয়ক সম্মেলন (কপ-২৯) অনুষ্ঠিত হলো আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে। সেখানে অংশগ্রহণ করার সৌভাগ্য হয়েছিল আমারও। এই সম্মেলনে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে তিনশ বিলিয়ন ডলার দেয়ার অঙ্গীকার করেছে ধনী দেশগুলো। জলবায়ু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রস্তুতি ও প্রতিরোধে সহায়তার জন্য এ তহবিল দেওয়া হবে। আজারবাইজানে অনুষ্ঠিত ওই সম্মেলনে সমঝোতার জন্য অতিরিক্ত ৩৩ ঘণ্টা সময় লেগেছে। বিগত সময়ের মতো সেখানে ক্ষতিপূরণের দাবি জোরালো ও যৌক্তিকভাবে তুলে ধরলেও আশাপ্রদ ফল অর্জিত হয়নি, তাই অন্যান্য সময়ের মতো এবারও হতাশ বাংলাদেশ। একইসঙ্গে হতাশ বিশ্বের অনেক গরিব ও মধ্যবিত্ত দেশ। কারণ তারাও অনেকটাই বাংলাদেশের মতোই পন্থা অনুসরণ করেছে কিংবা করে আসছে। ফলে এবার এই প্রশ্নটাও জোরালোভাবে উঠে এসেছে, এভাবে কপ আয়োজনের প্রয়োজনীয়তা আসলেও কতটুকু!
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কমবেশি বিশ্বের সকল দেশই আক্রান্ত, কিন্তু ক্ষতিগ্রস্থ কিংবা ঝুঁকির দিক থেকে অনেক তারতম্য রয়েছে। উল্লেখযোগ্য যে, বাংলাদেশের জলবায়ু ঝুঁকির তালিকায় শীর্ষস্থানে থাকার অন্যতম কারণ হলো ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ব্যাপকতা। ২০২২ সালে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং এবং ২০২৩ সালের সিলেটের অস্বাভাবিক বন্যা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
জীবনের মতোই বিশ্বও চলছে তার নিজস্ব গতিতে, এই গতিকে থামানো এখন অনেক কঠিন, উচিতও হয়তো না! আর এই গতির সঙ্গেই যুক্ত হয়েছে সকল প্রাণের বেঁচে থাকা, গতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মানুষ তার জীবনধারা এমনভাবে গড়ে তুলেছে, যার অনেকটাই পরিবর্তন করার মতো, যার আশু ইতিবাচক পরিবর্তনও প্রয়োজন— কারণ বিশ্বের মানুষের আচরণের কারণেই এখন জলবায়ুর প্রভাব আশঙ্কাজনকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই আচরণে ইতিবাচক ও পরিবেশবান্ধব পরিবর্তন দেশ, জাতি, গোষ্ঠী, ধর্ম, বর্ণ, বয়সভেদে সবাইকেই আনতে হবে। এই পরিবর্তন আনতে হবে পরিবারে, প্রতিষ্ঠানে, সমাজে ও রাষ্ট্রে— এর অন্য কোনো বিকল্প নেই। তা না হলে গরিব থেকে ধনী, উন্নত থেকে অনুন্নত প্রতিটি দেশই সার্বিকভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে আরও বাড়িয়ে দেবে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- ইতিবাচক
- পরিবর্তন
- জলবায়ু সম্মেলন