মনোভাবও সংস্কার হওয়া দরকার
ব্যক্তির একটি অন্যতম আচরণ অ্যাটিচিউড বা মনোভাব। ব্যক্তির ইতিবাচক গ্রহণযোগ্যতার জন্য প্রয়োজন তাঁর পজিটিভ অ্যাটিচিউড বা ইতিবাচক মনোভাব। সাধারণত দেখা যায়, অনেকেই একজন আরেকজনের অ্যাটিচিউড নিয়ে কথা বলছে, কথা বলতে ভালোবাসছে। অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। হয়তো তারা জানেই না যে একজন ব্যক্তির অ্যাটিচিউড আসলে কী ধরনের আচরণ। কথায় কথায় এমন বলতে শোনা যায় যে অমুকের অ্যাটিচিউড ভালো, তমুকের অ্যাটিচিউড ভালো নয়। অ্যাটিচিউড যে একজন ব্যক্তির আচরণের একটা অংশমাত্র এবং যা ব্যক্তির ব্যক্তিত্বকে দৃশ্যমান করতে একটি অন্যতম সহায়ক, সেই অন্তর্নিহিত সত্য অনেকেই জানে না। জানার আগ্রহও থাকে না। তার কারণ, জ্ঞানে জানার চেয়ে অধিকাংশ ব্যক্তিই প্রভাব, প্রতাপ আর আবেগে জানতে ভালোবাসতে শিখেছে। পোশাক-আশাকে যে যাকে যেমনভাবে দেখছে এবং যেটা বাইরে থেকে কেবল দেখা সম্ভব, সেই আলোকে তাকে চিনছে, জানছে, যা কিনা মস্ত ভুল ধারণা বা সিদ্ধান্ত। বলা যায়, অসম্পূর্ণ দেখা এবং প্রচলিত সামাজিক রীতিনীতি তাকে সেইভাবে অভ্যস্ত হতে সহায়তা করেছে। এর নেপথ্যে কিন্তু স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় থাকে।
অ্যাটিচিউড বা মনোভাব কী? এটা ব্যক্তির সেই আচরণ, যা ব্যক্তির বিশ্বাস, চিন্তাচেতনা, জ্ঞান, মেধার বহিঃপ্রকাশ ঘটায় তারই আলোকে কোনো কিছুকে দেখা, তার মূল্যায়ন করা। যেমন কে কাকে কীভাবে দেখে বা দেখছে বা দেখবে সেটা নির্ভর করে তার চিন্তাচেতনা, জ্ঞান, মেধা ও বিশ্বাসের ওপর এবং সর্বোপরি তার অভিজ্ঞতার ওপর। এককথায়, তার অর্জিত শিক্ষার ওপর। যদি তার অর্জিত জ্ঞান, চেতনা ও বিশ্বাস দুর্বল বা নেতিবাচক হয়, তাহলে সে ইতিবাচকভাবে কোনো কিছুই দেখবে না। হাজার চেষ্টায়ও তা দেখবে না। আবার উন্নত তথা ইতিবাচক মনোভাবের ব্যক্তিরা সবকিছুকেই ইতিবাচক দেখতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে এবং সেটা হয় তার অর্জিত জ্ঞান, মেধা, চেতনা ও বিশ্বাসের আলোকেই। এই বিবেচনায় একজন মন্দ ব্যক্তির যেমন অ্যাটিচিউড থাকে, তেমনই থাকে একজন উত্তম ব্যক্তির। পাথর্ক্য হলো, কারোটা মন্দ ও কারোটা উত্তম মনোভাব।
একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে যে সমাজে এমন অসংখ্য ব্যক্তি রয়েছে, যারা একটুতেই উত্তেজিত হয়ে ওঠে, চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে থাকে। যে প্রতিক্রিয়ায় হয়তো বিশ্লেষণের গুণগত মান ও যৌক্তিকতা থাকে না। সোজা কথায়, হুজুগে চলা ব্যক্তি এরা। অন্যের বুদ্ধিতে, চেতনা ও জ্ঞানে এরা চলতে ভালোবাসে। অনেকটা পরজীবী প্রাণীর মতো। ফলে অনুসরণীয় ব্যক্তির চিন্তাচেতনা পরিবর্তিত হলে এরাও রাতারাতি বদলে যায়। এ-জাতীয় ব্যক্তির নৈতিক বোধ বা আদর্শ বলতে মূলত কিছু থাকে না। যখন যে পাত্রে থাকে, তখন তারা সেই পাত্রের আকার ধারণ করে থাকে। নৈতিক মূল্যবোধ, আদর্শের প্রশ্নে এরা ভাড়া খাটে, অনেকটা খেপ মারার মতো! ফলে এদের মনোভাব কখনোই উন্নত বা ইতিবাচক হয় না। ভালো হোক বা মন্দ হোক, সব বিষয়কেই এরা একই মানদণ্ডে বিচার করে থাকে। মূল্যবোধ বা বিবেচনার দৌড়ে এরা অনেক পেছনে থাকে।
একটা বিষয় লক্ষণীয়, যেকোনো দেশের জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি, নৈতিক মূল্যবোধ সেই দেশের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার গুণগত দিকের ওপর নির্ভর করে। সাধারণত দেখা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সরকারদলীয় রাজনীতির স্বার্থসংশ্লিষ্টতায় পরিচালিত হয়। এমন সরকার জনগণের প্রত্যাশার চেয়ে দলীয় স্বার্থকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকে। জনগণের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আইনি অধিকার বিষয়ে তারা খুব মনোযোগ দেয় না। ফলে বিষয়গুলো যেনতেনভাবে পরিচালিত ও বাস্তবায়িত হয়। সেই সঙ্গে রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন দলীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিরা। ফলে রাজনৈতিক দলের দর্শন ও আদর্শ ভালো হোক কিংবা মন্দ হোক, তা সংক্রমিত হয় গোটা সমাজে, রাষ্ট্রে। সঙ্গে স্বেচ্ছাচারিতা, স্বজনপ্রিয়তা, দুর্নীতির মতো অপরাধ আর অনিয়মের বাম্পার ফলন হয়। এটা না বললেই নয়, বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতাকেন্দ্রিক আচরণ দেশকে যেমন ঝুঁকিতে ফেলেছে বারবার, ঠিক তেমনই জনগণের ভেতর দেশপ্রেম ও নৈতিক মূল্যবোধ সৃষ্টিতে চরম বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এককথায় ব্যর্থ হয়েছে। সব রাজনৈতিক সরকার আমলে তাই দেখা গেছে ইতিহাস নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি ও শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে ঘৃণ্য ছেলেখেলা। শিক্ষিত হয়েছে কিংবা শিক্ষিত হতে চেয়েছে শুধু কাগজের তৈরি একটা সার্টিফিকেট পাওয়ার জন্য, এমন প্রবণতার শিক্ষার্থী বেশি। আবার ছাত্ররাজনীতি করে অগাধ ধনসম্পদের মালিক বনে যাওয়ার সুযোগ, ব্যাংক-ব্যালান্স গড়ে ওঠার সমূহ সম্ভাবনা শিক্ষার্থীদের পড়াশোনাবিমুখ করেছে, কথাটা মিথ্যে নয়। চারপাশে এমন হাজারও দৃষ্টান্ত রয়েছে। শিক্ষার্থীদের মনোভাব বা দৃষ্টিভঙ্গি এমন হওয়ার পেছনকার অন্যতম কারণ হলো প্রচলিত রাজনৈতিক দর্শন ও রাজনৈতিক নেতারা।
- ট্যাগ:
- মতামত
- ব্যক্তিত্ব
- মনোভাব