আসাদের পতন ইসরায়েলকে চাঙ্গা করেছে
সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের পতনে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির ছক পাল্টে যেতে শুরু করেছে। স্পষ্টতই ইরান ও রাশিয়ার প্রভাব যতটুকু ছিল, তা অনেকটা মিইয়ে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। ইসরায়েলের পক্ষ থেকে কয়েক শ বিমান হামলার জবাবে সিরিয়ার নতুন শাসকগোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শামের (এইচটিএস) পক্ষ থেকে কোনো ধরনের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানানোর পরিবর্তে রুটিনমাফিক সমালোচনা করে বরং মধ্যপ্রাচ্যে সব সমস্যার মূল হিসেবে ইরানকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। সেই সঙ্গে ইসরায়েলের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের যে সমস্যাগুলো রয়েছে, সেগুলো কূটনৈতিক পন্থায় আলোচনার মধ্য দিয়ে সমাধানের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন এইচটিএস নেতা আহমেদ হোসাইন আল-শারা, যিনি আল-জোলানি নামে অধিক পরিচিত।
এদিকে আসাদ সরকারের পতনের পরপরই ইসরায়েল তাদের বসতি বিস্তারের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, যা দেশটির আইনসভায় এরই মধ্যে অনুমোদিত হয়েছে। ১৯৬৭ সালে ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরায়েল ও সিরিয়ার বাফার জোন হিসেবে পরিচিত গোলান মালভূমি দখল করে নিয়েছিল ইসরায়েল, যা এত দিন পর্যন্ত তাদের দখলে রয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী এই দখল অবৈধ হওয়ায় তারা এত দিন সেখানে পূর্ণাঙ্গভাবে বসতি স্থাপন করতে পারেনি। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর ভাষ্য অনুযায়ী, সিরিয়ার শাসক পরিবর্তন হওয়ায় আগের যুদ্ধবিরতি চুক্তি এখন আর কার্যকর নয়, ফলে তারা এর বাফার জোনে প্রবেশ করেছে এবং এই উপত্যকাটির জনসংখ্যা দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা নিয়েছে।
অবস্থাদৃষ্টে এটি ক্রমেই স্পষ্ট হতে শুরু করেছে যে সিরিয়ার এইচটিএস বিদ্রোহীরা এত দিন ধরে স্পষ্টতই ইসরায়েলের পরোক্ষ সমর্থনে প্রেসিডেন্ট আসাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হচ্ছিল এবং আসাদের পতনের পর ইসরায়েলের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের পথে তাই এইচটিএস কোনো বাধা হয়ে ওঠেনি। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী অবৈধ হওয়া সত্ত্বেও গোলানে বর্তমানে ৩০টি বসতিতে ২০ হাজারের বেশি ইসরায়েলি বসবাস করে আসছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর নতুন বসতি স্থাপন করা নিয়ে সিরিয়ার নতুন নেতৃত্বের সঙ্গে কোনো সংঘাত হবে না বলে আশা প্রকাশ করার অর্থ হচ্ছে এইচটিএসের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আগে থেকেই ইসরায়েলের সঙ্গে এক ধরনের বোঝাপড়া হয়ে ছিল, যদিও গত ৮ ডিসেম্বরের পর থেকে সিরিয়ায় অন্তত ৪৫০টি বিমান হামলা পরিচালনা করে ইসরায়েল, যা সীমা লঙ্ঘন এবং মধ্যপ্রাচ্যে নতুন উত্তেজনা তৈরির একটি আলামত হিসেবে উল্লেখ করেছেন আহমেদ শারা, তবে একই সঙ্গে তারা কোনো প্রতিবেশীর সঙ্গে নতুন করে কোনো উত্তেজনায় যেতে চান না বলেও মন্তব্য করেছেন, যার থেকে এটি বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে কোনোভাবেই তারা ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্কের অবনমন চান না। অন্যদিকে ইসরায়েলের তরফ থেকে এই হামলাগুলোকে ইরানের লক্ষ্যবস্তুকে উদ্দেশ করে এবং নিরাপত্তার স্বার্থে করা হয়েছে বলে সিরিয়াকে আশ্বস্ত করা হয়েছে।
সিরিয়ার সরকার পতনের পর ইসরায়েলের উদ্দেশ্য অনেকটা পরিষ্কার হয়ে গেছে। এর মধ্য দিয়ে তারা সিরিয়াকে ভবিষ্যতে এমনভাবে নিষ্ক্রিয় করতে চাইছে, যাতে সিরিয়ার পক্ষ থেকে ভবিষ্যতে ইসরায়েলের ওপর কোনো ধরনের হামলা বা নাশকতার আশঙ্কা না থাকে। তারা এরই মধ্যে যে বিমান হামলাগুলো পরিচালনা করেছে, এর মধ্য দিয়ে ব্যাপকভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে সিরিয়ার অনেক সামরিক স্থাপনা, অস্ত্র উৎপাদন কারখানা, অস্ত্রাগার, যুদ্ধবিমান, যুদ্ধজাহাজ এবং ক্ষেপণাস্ত্র। এসবই ইরানের সহায়তায় গড়ে উঠেছিল। তাদের দিক থেকে যদিও এই হামলার উদ্দেশ্য হিসেবে সন্ত্রাসী লক্ষ্যবস্তুগুলোকে আঘাত করার কথা বলা হয়েছিল, বাস্তবে এর মধ্য দিয়ে তারা সিরিয়ার সক্ষমতার জায়গায় আঘাত করেছে এবং নিজেদের ভবিষ্যেক সুরক্ষিত রাখতে চেয়েছে।
একই সঙ্গে গোলানে বাফার জোন পুরোপুরি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে ইসরায়েল। প্রেসিডেন্ট আসাদের ক্ষমতাচ্যুতির দিনটিকে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু মধ্যপ্রাচ্যের জন্য ঐতিহাসিক দিন হিসেবে ব্যক্ত করেছেন। মূলত এটিই তার দীর্ঘদিনের চাওয়া ছিল, যার মধ্য দিয়ে নিজেদের পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হওয়া যায়।
সিরিয়ায় এই রাজনৈতিক পরিবর্তন মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের শক্তিবৃদ্ধি ঘটাবে বলে বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, যদিও এই পরিবর্তনের জন্য প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু নিজ নিজ জায়গা থেকে কৃতিত্ব দাবি করছেন। তারা এটি করতেই পারেন। বছরাধিককাল ধরে গাজা যুদ্ধ, গাজা ছাড়িয়ে যখন লেবাননের হিজবুল্লাহর দিকে বিস্তৃত হয়, ইরানের প্রভাবের জায়গায় তা বড় ভূমিকা রাখে। মার্কিন অস্ত্র আর অর্থ সহায়তা এবং ইসরায়েলের অভিযান—এই দুইয়ের সমন্বয়ে একদিকে ইরানকে ব্যতিব্যস্ত রাখা, অন্যদিকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইউক্রেনকে সহায়তা করার মধ্য দিয়ে আসাদের প্রধান দুই পৃষ্ঠপোষক ইরান ও রাশিয়াকে কার্যত আসাদের প্রতি মনোযোগকে অন্যদিকে ধাবিত করে। সেই সঙ্গে ইরানের মিত্র হিজবুল্লাহ নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে ব্যস্ত থাকায় আসাদকে রক্ষায় কোনো ধরনের ভূমিকা তারা পালন করতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে সিরিয়ার বিদ্রোহীরা ইসরায়েলের কাছ থেকে প্রত্যক্ষ মদদ না পেলেও ইরানবিরোধী তৎপরতা থেকে তারা বাড়তি শক্তি সঞ্চার করেছে, যার জেরে ২৭ নভেম্বর যখন ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, সেদিনই বিদ্রোহীরা সিরিয়ার গুরুত্বপূর্ণ আলেপ্পো শহর নিজেদের দখলে নেয়। বিদ্রোহীরা গোলানে ইসরায়েলের আগ্রাসন নিয়ে সংক্ষুব্ধ হলেও তাত্ক্ষণিকভাবে তাদের পক্ষে ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে গোলানের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের করে নেওয়ার মতো অবস্থায় তারা নেই।