স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনাপর্ব
১৯৬৯ সালের আইয়ুববিরোধী ছাত্র-আন্দোলন ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনা। ১৯৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধের সাংগঠনিক কাঠামো ও মানসিক প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল, ১৯৬৯-এর পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসনবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। দেশের অন্যান্য ঐতিহাসিক আন্দোলনের মতো ১৯৬৯-এর আন্দোলনও শুরু হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, ডাকসুর (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ) নেতৃত্বে।
উনসত্তরের আন্দোলন নিয়ে খুব একটা লেখালেখি বা বিশ্লেষণ হয়নি। এর প্রধান কারণ সম্ভবত ১৯৬৯ ও ১৯৭১-এর মাঝে সময়ের দূরত্ব। ১৯৬৯-এর রেশ শেষ হতে না হতেই শুরু হয়ে যায় ১৯৭১-এর সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম। পাকিস্তানি বাহিনীর সীমাহীন বর্বরতা ও বাংলার মানুষের দুর্বার প্রতিরোধের অসংখ্য ঘটনাবলির মাঝে চাপা পড়ে যায় ১৯৬৯-এর অনেক না-বলা কাহিনি।
সময়টা ১৯৬৯। ঘটা করে পালিত হচ্ছে আইয়ুব খানের বাংলাকে শোষণের আরও এক দশক, সরকারি নাম ‘ডিকেড অফ রিফরমস’। চারদিকে খুব ধুমধাম, আইয়ুব শাসনের এক দশক সম্পন্ন হলো। পাকিস্তানের সরকারি মাধ্যমগুলোতে সারাক্ষণ প্রচারিত হচ্ছে আইয়ুব খানের জয়জয়কার। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অনুগত গভর্নর মোনেম খানের নেতৃত্বে একদল তোষামোদকারী বাঙালিও ঢাকঢোল নিয়ে বাজনা বাজাচ্ছে।
১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান লাহোরে বিরোধী দলগুলোর এক সভাতে ছয় দফা দাবি উপস্থাপন করে পূর্ব বাংলার মানুষের স্বতন্ত্র ও স্বাধিকারের ঘোষণা দেন। অন্যদিকে, পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী বাংলাদেশকে চিরতরে পাকিস্তানের কলোনি বানিয়ে রাখার জন্য ষড়যন্ত্রের নীল নকশার বাস্তবায়ন শুরু করে। ১৯৬৮ সালের ৬ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার একটা প্রেস নোট জারি করে। সেখানে বলা হয়, পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার একটা নীলনকশা তৈরি করা হয়েছে আগরতলায়। ১৮ জানুয়ারি ঘোষণা করা হয়, এ ষড়যন্ত্রের প্রধান আসামি হলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯ মে আরও কয়েকজনসহ শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে জেলখানায় নেওয়া হয়। শেখ মুজিবকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার এক নম্বর আসামি করে বিচার শুরু হয় বিশেষ সামরিক আদালতে। চারদিকে থমথমে ভাব। ভীতসন্ত্রস্ত পরিবেশ। রাজনৈতিক নেতারা সবাই কারারুদ্ধ বা পলাতক।
রাজনৈতিক নিগ্রহের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সরকারি প্রচার মাধ্যমগুলোতে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার বন্ধ করে দেয়। বাংলা ভাষাকে উর্দুকরণ করার প্রক্রিয়াও শুরু হয়। ‘বিমান’ হয়ে যায় ‘হাওয়াই জাহাজ’, ‘সংবাদ’ হয় ‘সমাচার’। মাঝে মাঝে শুধু প্রতিবাদ শোনা যেত সাংস্কৃতিক অঙ্গন থেকে। রমনার বটমূলে রবীন্দ্রসংগীতের অনুষ্ঠানে শ্রোতাদের সংখ্যা বেড়ে হয় দশগুণ। শামসুর রাহমানের ‘আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’ কবিতাটি খুব আলোড়ন সৃষ্টি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে। বিশ্ববিদ্যালয় হলগুলোতে আইয়ুব-মোনেমের আজ্ঞাবহ এনএসএফের দৌরাত্ম্যে প্রগতিশীল ছাত্রমহল তখন একদম কোণঠাসা। এমনই শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ।
আস্তে আস্তে প্রতিবাদের কাঠামো গড়ে উঠতে থাকে। তোফায়েল আহমেদ তখন ডাকসুর সহ-সভাপতি। ডাকসুর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। মূল লক্ষ্য, সব রাজবন্দিকে কারাগার থেকে বের করে আনা। আগরতলা ষড়যন্ত্রের উদ্ধত ছোবল থেকে বাঁচাতে হবে বাংলার সেই সাহসী মানুষগুলোকে। নতুবা এদের সবার ফাঁসি হয়ে যাবে সামরিক আদালতে। মোট এগারো দফার ভিত্তিতে তাই আন্দোলনের কর্মসূচি দেওয়া হয়। শেখ মুজিবের দেওয়া ছয়দফা দাবিও হয় এর অন্তর্ভুক্ত।
সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে প্রথমে ছিল শুধু ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া/সামসুদ্দোহা)। ছাত্রলীগ তখন ভাগ হয়নি, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্ববৃহৎ দল। প্রতিদিন সভা হতো বটতলায়। বক্তৃতা করতেন তোফায়েল আহমদসহ অন্য ছাত্র নেতারা। প্রথমে খুব ছোট পরিসরে সমাবেশ হতো। আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে ছাত্রদের অংশগ্রহণ। যোগ দেয় বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন ও ইসলামি ছাত্র সংঘের মতো অন্য ছাত্র দলগুলোও। বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন ছিল চারু মজুমদারের নকশাল আন্দোলনের সমর্থক। পশ্চিম বাংলায় তখন নকশাল আন্দোলন তুঙ্গে। যদিও বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য ছিল খুব সীমিত, বটতলায় এদের দেখা যেত মাথায় লাল ফিতা বেঁধে বেশ জঙ্গিভাবে মঞ্চের কাছে স্লোগান দিতে। আস্তে আস্তে বাইরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরাও মিছিল করে সমাবেশে আসতে শুরু করল। ঢাকা কলেজ, জগন্নাথ কলেজ প্রায়ই আসত। একদিন হঠাৎ একটা নতুন মিছিল এলো, ধানমন্ডি রেসিডেন্সিয়াল স্কুল থেকে। আমরা সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে দেখলাম সেই অল্পবয়সি ছেলেগুলোকে।
এদিকে আন্দোলন আরও তীব্রতর হতে লাগল। সরকারি প্রতিরোধও বাড়তে থাকল। ছাত্ররা চেষ্টা করত মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেট দিয়ে বের হতে। কোনোভাবেই তা সম্ভব ছিল না। প্রতিদিনই পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর লাঠিচার্জ ও টিয়ার গ্যাস প্রতিরোধ করত মিছিলের যাত্রা। তবে যতই প্রতিরোধ বাড়ল, আন্দোলন আরও তীব্রতর হলো, সমাবেশও বড় হতে থাকল।
- ট্যাগ:
- মতামত
- স্বাধীনতা যুদ্ধ