‘বৈষম্যহীন’ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় যেসব পরিবর্তন প্রয়োজন
১৯৭১–এর মুক্তিযুদ্ধের প্রধান আকাঙ্ক্ষা ছিল বৈষম্যহীন সর্বজনের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। কিন্তু ১৯৭২ থেকেই শুরু হয় সেই আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশার ওপর আঘাত। এই কয়েক দশকে সামরিক ও বেসামরিক স্বৈরশাসনই ছিল প্রধান প্রবণতা। এত বছরে আমরা কখনোই স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পাইনি।
বৈষম্যহীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বদলে উল্টো বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। বৈষম্যবাদী রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতির দাপট বেড়েছে। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র নাম করে এ যাত্রায় সবচেয়ে ভয়ংকর ছিল শেখ হাসিনা ও তাঁর দলবলের শাসন। ২৪–এর গণ–অভ্যুত্থান সেই ‘বৈষম্যহীন সর্বজনের বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষাকে আবার সামনে এনেছে। সে কারণে আমি মনে করি, ২৪–এর গণ–অভ্যুত্থান আসলে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জনগণের লড়াই ও প্রত্যাশারই ধারাবাহিকতা।
এ পরিপ্রেক্ষিতে সংবিধানকে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার যাত্রার সহযোগী করতে এর বেশ কিছু অনুচ্ছেদে/শব্দ/নীতি পরিবর্তন খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি। সংক্ষেপে তার কয়েকটি দিক এখানে তুলে ধরছি।
১. সংবিধানের শুরু হবে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি, মুক্তিযুদ্ধে জনগণের বিপুল অংশগ্রহণ ও লড়াইয়ের সংক্ষিপ্ত বিবরণ এবং এর মাধ্যমে অর্জিত রাষ্ট্রের প্রধান আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করে। এর সঙ্গে ১৯৯০ ও ২০২৪–এর গণ–অভ্যুত্থানসহ গত ৫৩ বছরে স্বৈরশাসনবিরোধী লড়াইয়ের উল্লেখ থাকতে হবে।
২. সংবিধানে ইংরেজিতে বাংলাদেশের নাম যথার্থভাবেই ‘পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’। এর বাংলা করা হয়েছে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’। আমি মনে করি, রিপাবলিকের বাংলা ‘প্রজাতন্ত্র’ ঠিক হয়নি। রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করেই এই রিপাবলিক ধারণা। প্রজা বলতে এখানে নাগরিকদেরই বোঝানো হয়েছে, কিন্তু রূপক হোক আর যা–ই হোক, প্রজা শব্দের সঙ্গে প্রচলিত ধারণা রাজা সন্ধান করে।
আমাদের অভিজ্ঞতায় বাংলাদেশের ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের রাজা/রানি/জমিদার হওয়ার সামন্তবাদী প্রবণতা প্রজা শব্দের পরিবর্তন আরও জরুরি করে তুলেছে। এই শব্দের ভালো বিকল্প আছে। আমি মনি করি, বাংলা যথার্থ নাম হতে পারে ‘জনতন্ত্রী’, ‘জনগণতন্ত্রী’ বা ‘সর্বজনতন্ত্রী’ বাংলাদেশ।
৩. মূলনীতি: ৮ (১) অনুচ্ছেদে বর্ণিত চার মূলনীতির বদলে আমরা এক মূলনীতিতে আসতে পারি। তা হতে পারে এ রকম, ‘জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ, ভাষা নির্বিশেষে সব নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করে সর্বজনের বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা।’
এভাবে লিখলে জাতীয়তাবাদের নামে একটি জাতির দাপট দেখা যাবে না, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র শব্দ ঝুলিয়ে রেখে ‘উল্টোযাত্রা’র প্রহসনও হবে না। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও কাজ পরিষ্কার হবে। সব ক্ষেত্রে ধর্ম বিষয়ে রাষ্ট্রকে অবশ্যই পক্ষপাতহীন বা নিরপেক্ষ অবস্থান নিশ্চিত করতে হবে, সংবিধান এবং আইন বিধিব্যবস্থার সব ক্ষেত্রে তার প্রতিফলন থাকতে হবে। অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থার এটি প্রাথমিক শর্ত।
৪. নির্বাচন ও ক্ষমতার ভারসাম্য: সংসদ নির্বাচন সংখ্যানুপাতিক করার দিকে ক্রমে যেতে হবে। নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা বাড়াতে হবে। ‘না’ ভোট এবং নির্বাচিত সংসদ সদস্য প্রত্যাহারের বিধান যোগ করতে হবে।
৫. রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী: রাষ্ট্রপতির পদবি ও দায়িত্বের পরিবর্তন দরকার। রাষ্ট্রপতির বদলে বলা যেতে পারে রাষ্ট্রপ্রধান। সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচনও হতে পারে প্রত্যক্ষ ভোটে; মানে প্রধানমন্ত্রীর ওপর নির্ভরশীল নন এবং তাঁর ক্ষমতার আলাদা এখতিয়ার থাকবে।
প্রধানমন্ত্রী সংসদে বিজয়ী দলের নেতা হিসেবে নির্বাচিত হবেন। নির্বাচিত হওয়ার পর দলীয় প্রধানের পদ ছেড়ে দিতে হবে। ভারসাম্যের জন্য রাষ্ট্রপ্রধান নির্দলীয় হতে পারেন। রাষ্ট্রপ্রধান ও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বকাল অবশ্যই দুই মেয়াদের বেশি নয়। সরকারের মেয়াদ হতে পারে চার বছর।
- ট্যাগ:
- মতামত
- বৈষম্য দূর
- বাংলাদেশের সংবিধান