পরিসংখ্যানের ভোজবাজি ও খেলাপি ঋণ
একজন ম্যানেজার নিয়োগ দেয়ার জন্য এক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিক চাকরিপ্রার্থীদের ইন্টারভিউ নিচ্ছিলেন। যোগ্য প্রার্থী বেছে নেয়ার জন্য তিনি সবাইকে একটা মাত্র প্রশ্ন করছিলেন, ‘দুই আর দুই যোগ করলে কত হয়?’ প্রথম প্রার্থী ছিলেন এক সাংবাদিক। তার জবাব ছিল ২২। দ্বিতীয় প্রার্থী ছিলেন এক প্রকৌশলী, তিনি অংক কষে দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে এটা হবে ৩.৯৯৯ এবং ৪.০০১ এর মাঝামাঝি একটা সংখ্যা। পরের প্রার্থী ছিলেন এক আইনজীবী। তিনি তার জবাবে বলেন যে এটা রাজস্ব বোর্ডের বিরুদ্ধে করা এক মামলায় প্রমাণিত হয়েছিল যে দুই আর দুইয়ে চার হয়। সর্বশেষ প্রার্থী ছিলেন একজন অ্যাকাউন্ট্যান্ট। তাকেও জিজ্ঞাসা করা হয় ‘দুই আর দুইয়ে কত?’ অ্যাকাউন্ট্যান্ট উঠে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে আবার চেয়ারে এসে বসেন, তারপর টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ে গলার স্বর নামিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘আপনি কত চান?’ বলা বাহল্য, চাকরিটা তিনিই পেয়েছিলেন।
গল্পটা পড়ে অ্যাকাউন্টিং কিংবা অন্য পেশার পাঠকরা দয়া করে বেজার হবেন না। আমাদের দেশে এমন প্রচুর উদাহরণ পাওয়া যাবে যেখানে সাধারণ শেয়ারহোল্ডার, ব্যাংক ও আয়কর বিভাগকে ধোঁকা দেয়ার জন্য কারসাজি করা হয় ব্যালান্স শিটে। তবে কেবল আমাদের মতো দুর্বল অবকাঠামোসম্পন্ন দেশেই যে কেবল এ-জাতীয় অনিয়ম হচ্ছে তা নয়, এমন সব ঘটনা ঘটেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও। আমাদের স্মরণে আছে, এনরন করপোরেশন, জেরক্স করপোরেশন, এডেলফিয়া কমিউনিকেশন কিংবা ওয়ার্ল্ডকম ইনকরপোরেটেডের মতো বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলো অ্যাকাউন্টিং কারসাজি এবং ব্যালান্স শিট ভোজবাজির কারণে দেউলিয়া হয়ে গেছে।
অ্যাকাউন্টিং কারসাজির বহু কারণ ও কায়দা থাকতে পারে। কখনো এ কারসাজি হয় বিভিন্ন সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়ে, আবার কখনো কমিয়ে দিয়ে। এ কারসাজি করা হয় অসদুদ্দেশ্যে। মুনাফা বেশি দেখানো হয় বাড়তি লভ্যাংশের জন্য, আবার কম দেখানো হয় কর ফাঁকি দেয়ার জন্য। দুর্জনরা বলেন, বহু ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান দুটো ব্যালান্স শিট প্রস্তুত করে—একটা নিজেদের জন্য, আরেকটা আয়কর রিটার্নের সঙ্গে জমা দেয়ার জন্য। একইভাবে একটা দেশের তথ্য-উপাত্তে যখন কারসাজি করা হয়, তার পেছনেও কোনো সৎ উদ্দেশ্য থাকে না। আগস্ট ২০২৪ সালে সরকার পরিবর্তনের পর অর্থনীতির শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি আবিষ্কার করেছে যে বিগত বছরগুলোয় জনগণের সামনে অর্থনীতির ফাঁপানো অবস্থা তুলে ধরে সরকারের ভাবমূর্তি বাড়ানোর জন্য দেশের জিডিপি ও মূল্যস্ফীতির পরিসংখ্যানে বহু কারসাজি করা হয়েছে। কমিটির অনুসন্ধানে দেখা গেছে, তথ্য-উপাত্তে কারসাজির ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে আ হ ম মুস্তফা কামাল অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকার সময়ে। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতির প্রকৃত হার কমিয়ে এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বাড়িয়ে দেখানো হতো। যেমন ২০২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি দেখানো হয়েছিল ৬ দশমিক ৩ শতাংশ, কিন্তু সরকার পরিবর্তনের পর আগস্ট ২০২৪ সালে প্রকাশিত চূড়ান্ত হিসাবে সেই হার নেমে এসেছে ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- খেলাপি ঋণ
- ব্যাংক খাত