বৈশ্বিক রূপান্তরে তিন শূন্যের নীতি
বিশ্বব্যাপী তরুণ-যুবকদের হৃদয়ে আদর্শিক চেতনা প্রতিষ্ঠার তেমন কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয় না। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস ব্যতিক্রম। তিনি যুবসমাজকে সামাজিক ব্যবসায় সম্পৃক্ত হয়ে নতুন ধারণার বশবর্তী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। হন্যে হয়ে চাকরি অনুসন্ধানে মেধাসম্পদ, শ্রম ও সময়ক্ষেপণ না করে নিজে কর্মসংস্থানের উদ্যোক্তা হওয়ার অভিনব পন্থার উদ্ভাবন ঘটিয়েছেন। তিনি বিশ্বপরিমণ্ডলে বিরাজমান তিনটি সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে (সম্পদ কেন্দ্রীভূতকরণ, বেকারত্ব ও কার্বন নিঃসরণ) শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। আমরা জানি, দারিদ্র্য বর্তমান বিশ্বের প্রধান সমস্যা। সম্প্রতি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাকেন্দ্র অক্সফোর্ড পোভার্টি অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ এবং ইউএনডিপির যৌথ উদ্যোগে ‘বৈশ্বিক বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক-২০২৪ : সংঘাতের মধ্যে দারিদ্র্য’ শিরোনামে এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ১১২টি দেশের ৬৩০ কোটি মানুষের ওপর পরিচালিত এ গবেষণায় ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত এক দশকের বেশি সময়ের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
এ গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের ১১০ কোটি মানুষ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করছে। তাদের প্রায় অর্ধেকই সংঘাতকবলিত দেশের বাসিন্দা। চরম দারিদ্র্যে থাকা জনগোষ্ঠীর ৮৩ শতাংশের বেশি বসবাস করে আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে। দক্ষিণ এশিয়ায় ২৭ কোটি ২০ লাখ দরিদ্র মানুষের মধ্যে এমন পরিবারও আছে, যে পরিবারে অন্তত একজন অপুষ্টিতে ভুগছেন। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, চরম দারিদ্র্যের মধ্যে থাকা ৪৫ কোটি ৫০ লাখ মানুষ সংঘাত-সহিংসতার মধ্যে বসবাস করছে। সংঘাতপূর্ণ দেশগুলোয় শিশুমৃত্যুর হার ৮ শতাংশ। পক্ষান্তরে শান্তিপূর্ণ দেশগুলোয় এ হার মাত্র ১ দশমিক ১ শতাংশ। যুদ্ধরত দেশগুলোর মানুষ পুষ্টি, বিদ্যুৎ, পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, যার উদাহরণ বর্তমান গাজা উপত্যকা। ‘ফেমিন রিভিউ কমিটি’ নামক সংস্থার মূল্যায়নে জানা যায়, দখলদার ইসরাইলের অবরোধ, খাবার পৌঁছাতে না দেওয়া এবং বর্বর হামলার কারণে দুর্ভিক্ষের কবলে পড়তে যাচ্ছে গাজার উত্তরাঞ্চলের বাসিন্দারা। দুর্ভিক্ষ শুরু হওয়ার ধাপ হয়তো ইতোমধ্যে পার হয়ে গেছে বা খুবই দ্রুত পার হবে। সংস্থাটির মতে, ২০২৪ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত গাজায় খাদ্য ঝুঁকিতে থাকা মানুষের সংখ্যা হতে পারে ৩ লাখ ৪৫ হাজার, যা উপত্যকাটির মোট জনসংখ্যার ১৬ শতাংশ।
উন্নত দেশগুলোয়ও দারিদ্র্যের একই দৃশ্যপট অবলোকন করা যাচ্ছে। গত ৯ অক্টোবর প্রকাশিত বেসরকারি সংস্থা ট্রাসেল ট্রাস্ট পরিচালিত গবেষণা অনুযায়ী, বিশ্বের প্রথম সারির উন্নত দেশগুলোর অন্যতম যুক্তরাজ্যে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বিশেষ করে করোনা মহামারির পর থেকে, অর্থনীতি ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে দেশটিতে বেড়েছে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য। বর্তমানে ৯৩ লাখ মানুষ ক্ষুধা ও দুর্দশার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ইতঃপূর্বে দেশটিতে একসঙ্গে এতসংখ্যক মানুষ কখনো এ পরিস্থিতিতে নিপতিত হয়নি। বিস্ময়করভাবে দুই দশক আগের তুলনায় বর্তমানে ৪৬ শতাংশ বেশি শিশু ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের মুখোমুখি। চার বছরের কম বয়সি প্রায় এক-চতুর্থাংশ শিশু চরম দারিদ্র্য মোকাবিলা করছে। ইউনিসেফের ২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ধনী দেশগুলোর মধ্যে শিশু দারিদ্র্যের হার সবচেয়ে বেশি যুক্তরাজ্যে। বর্তমানে ৬ কোটি ৯২ লাখ ৫১ হাজার জনসংখ্যার দেশটির ২৫ শতাংশ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। দাতব্য সংস্থা বাট্ল ইউকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাজ্যে অনেক দরিদ্র পরিবারকে ভীষণ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জীবন পার করতে হচ্ছে। খাবার, পোশাক থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় উপকরণের সংকটে ভুগছে বহু পরিবার।
বিশ্বজুড়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈষম্য বৃদ্ধি ও স্থবির উৎপাদনশীলতার নেতিবাচক প্রভাবে বেকারত্বের হার হ্রাসের চিত্র সুস্পষ্ট। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) হিসাব অনুসারে বিশ্বে এখন বেকারত্বের হার ১৩ শতাংশ, যা বিগত ১৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন-যদিও করোনা অতিমারির পর বিশ্বের সব অঞ্চলে বেকারত্বের হার সমানভাবে কমেনি। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার সুবিধা না পাওয়ায় কিছু অঞ্চলে বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। আন্তর্জাতিক যুব দিবস উপলক্ষ্যে প্রকাশিত আইএলওর প্রতিবেদন ‘গ্লোবাল এমপ্লয়মেন্ট ট্রেন্ডস ফর ইয়ুথ ২০২৪’-এ জানানো হয়েছে, গত চার বছরে শ্রমবাজারের উন্নতি ঘটেছে। এ ধারাবাহিকতা আগামী দুই বছর বজায় থাকতে পারে। চলতি বছর ও আগামী বছর বেকারত্বের হার আরও কমে ১২ দশমিক ৮ শতাংশে দাঁড়াবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০২৩ সালের হিসাবে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় বেকারত্বের হার ছিল ১৫ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৩ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে বাংলাদেশে কর্মহীন মানুষ ছিল ২৫ লাখ। চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে দেশে বেকারত্বের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৬৫ শতাংশে। আগের বছরের একই সময়ে এটি ছিল ৩ দশমিক ৪১ শতাংশ।
- ট্যাগ:
- মতামত
- অন্তর্বর্তী সরকার
- যুবসমাজ
- রূপান্তর