অতীতের ‘রাজাকার ফোবিয়া’ থেকে বর্তমানের ‘লীগ ফোবিয়া’

সমকাল মোশতাক আহমেদ প্রকাশিত: ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৪৮

তিন মাসেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনা রেজিমের পতন ঘটেছে। দীর্ঘ দেড় দশক ক্ষমতায় থাকা দলটি যে এমনভাবে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে– এটা মনে হয় তার শত্রুরাও ভাবতে পারেনি। কিন্তু কেন এমন হলো? ইতোমধ্যে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা দলটির এই পরিণতির জন্য নানাবিধ কারণ অনুসন্ধানের প্রয়াস পাচ্ছেন। ব্যক্তি হাসিনার একনায়কতান্ত্রিক আচরণ, সরকারের কর্তৃত্ববাদিতা, গণতন্ত্র ও বাক্‌স্বাধীনতা হরণ, দুর্নীতি, বিরোধী দলকে রাজনীতির সুযোগ না দেওয়া, দলের অঙ্গ সংগঠনগুলোর লাগামহীন সন্ত্রাস– এমন আরও কত! কেউ কেউ আবার দীর্ঘদিনের সুচারু  ‘পরিকল্পিত পরিকল্পনা’র কথাও বলছেন। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে যে বিষয়টা আমার কাছে দলটির পতনের জন্য অন্যতম কারণ মনে হয় তা হলো, আওয়ামী লীগের ‘রাজাকার ফোবিয়া’।


১৫ বছরের শাসনামলে বলতে গেলে পুরোটাই আওয়ামী লীগ এই রাজাকার ফোবিয়ায় ভুগেছে। তৃণমূল থেকে দলীয় প্রধান পর্যন্ত সবাই এতে আক্রান্ত হয়েছেন। যখনই কেউ সরকারের সমালোচনা করতে চেয়েছে, প্রায় সর্বক্ষেত্রে তাকে প্রকারান্তরে রাজাকার ট্যাগ দেওয়ার চেষ্টা চলেছে। হোক সেটা সাধারণ ছাত্রদের কোনো আন্দোলন কিংবা শ্রমিকের মজুরির দাবিতে; সবকিছুকেই তারা দেখেছে ‘স্বাধীনতাবিরোধীদের ষড়যন্ত্র’ হিসেবে। এমনকি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে কথা বলতে গেলেও রাজাকার হতে হয়েছে। আওয়ামী লীগের এই রাজাকার আখ্যা থেকে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অংশীদার কমিউনিস্ট পার্টি পর্যন্ত রেহাই পায়নি। এমনকি অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যারা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে কাজ করেছেন, তারাও যদি আওয়ামী লীগের কোনো কাজের সমালোচনা করেছেন, তাদেরও রাজাকার অভিধায় ভূষিত করতে এতটুকু পিছপা হয়নি মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া দলটি। নিয়তির নির্মম পরিহাস; আখেরে রাজাকার ফোবিয়াই ক্ষমতা থেকে আওয়ামী লীগের বিদায়ের অন্যতম অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে।


১৫ বছরের শাসনামলে আওয়ামী লীগ মনে হয় ভুলেই গিয়েছিল, অতি ব্যবহারে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। সামান্য বিরোধিতার গন্ধ পেলেই যাকে খুশি তাকে অহেতুক ও অপ্রাসঙ্গিকভাবে ‘রাজাকার’ বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে রাজাকার শব্দটির প্রতি মানুষের যে ঘৃণাবোধ ছিল, তা দূরীভূত হতে হতে ফিকে হয়ে গেছে। অথচ এ দেশের মানুষ জানে, একাত্তরে রাজাকার বাহিনীর কী ভূমিকা ছিল। এটা নিয়ে এত ফোবিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার কিছু ছিল না। অথচ এই সাধারণ বিষয়টি বেশি ঘাঁটতে গিয়ে নিজেরই সর্বনাশ ডেকে এনেছে আওয়ামী লীগ। ঠিক যেমনটি তারা ঘটিয়েছে বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রে। রাস্তাঘাট, বাজার-গঞ্জ, যেখানে সেখানে তৈরি করেছে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল, যার কোনো প্রয়োজনই ছিল না।



আসলে কোনো দেশের শাসকগোষ্ঠী যখন সত্যকে স্বীকার করতে ভয় পায়, তখনই খুঁজে নেয় অদৃশ্য অজুহাত। তা থেকেই জন্ম নেয় ফোবিয়া। আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে এমনই ঘটেছে। তারা সব অপকর্ম ঢাকতে গিয়ে বারবার একাত্তরকে সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছে। তারা জানত, একাত্তরের প্রতি দেশের আপামর মানুষের বিশেষ আবেগ রয়েছে। তারা সেই আবেগকেই ‘চেতনা’ নাম দিয়ে বিরোধী মত দমনে ব্যবহার করতে চেয়েছে। সে জন্যই নিয়ে এসেছে রাজাকার প্রসঙ্গ। একটা সময়ে সেটিই রূপ নিয়েছে ফোবিয়ায়।


অবশ্য রাজনীতিতে এই ফোবিয়া ব্যাধি নতুন কিছু নয়। উনিশ শতকের মাঝামাঝি ইউরোপের বুর্জোয়া শাসকগোষ্ঠীও কমিউনিজম ফোবিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিল। অনেকটা অশরীরী ভূত দেখার মতো। এই উপলব্ধি থেকেই হয়তো কার্ল মার্ক্স তাঁর ঐতিহাসিক কমিউনিস্ট ইশতেহারে শুরুতেই লিখেছিলেন– ‘ইউরোপ ভূত দেখছে– কমিউনিজমের ভূত। এ ভূত ঝেড়ে ফেলার জন্য এক পবিত্র জোটের মধ্যে এসে ঢুকেছে সাবেকি ইউরোপের সব শক্তি।’ পাকিস্তানি শাসকরাও ফোবিয়ায় আক্রান্ত ছিল। ষাটের দশকের শুরুতে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন দানা বাঁধতে আরম্ভ করলে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ফোবিয়া আক্রান্ত হওয়া শুরু করে দুটো বিষয় ঘিরে– ভারত এবং কমিউনিজম। কেউ কথা বলতে গেলেই তাকে হয় ভারতের চর, না-হয় কমিউনিস্ট অভিধায় ভূষিত হতে হয়েছে।
স্বাধীনতার পরও শাসকগোষ্ঠী ভারত ফোবিয়া থেকে মুক্ত হতে পারেনি। নব্বইয়ের দশকে বিএনপি যখন ক্ষমতায়, প্রায়ই বলত– আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে নোয়াখালী পর্যন্ত ভারতের অংশ হয়ে যাবে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে কারণে-অকারণে রাজাকার প্রসঙ্গ সামনে নিয়ে এসেছে– যত না চেতনাগত অবস্থান থেকে, তার চেয়ে বেশি অপকর্ম থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দেওয়ার জন্য। এটা করে তারা দেশে একটা রাজনৈতিক বাইনারি তৈরি করে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করেছে। আখেরে সেটাই হয়েছে বুমেরাং।


৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে। স্বাভাবিকভাবেই মানুষের আকাঙ্ক্ষা আর প্রত্যাশাতেও যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা। কিন্তু লক্ষ্য করা যাচ্ছে, এই অন্তর্বর্তী সরকারও অতীতের সরকারগুলোর মতো ফোবিয়ায় আক্রান্ত হতে যাচ্ছে। কোথাও কিছু একটা ঘটলেই সেখানে ‘লীগ’-এর অস্তিত্ব খোঁজা শুরু হয়ে যায়। অথচ বাস্তবতা হলো, জনসমর্থন থাকলেও সাংগঠনিকভাবে আওয়ামী লীগ বর্তমানে প্রায় অস্তিত্বহীন। তাদের সব সারির প্রায় সব নেতাই হয় কারাগারে, না-হয় দেশান্তরে, না-হয় পলাতক। এই অবস্থায় দলটি অন্তর্বর্তী সরকারকে বিপাকে ফেলতে কতটুকু শক্তি রাখে– তা প্রশ্নাতীত নয়।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও