সরকার কীভাবে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে তা বোঝা যাচ্ছে না
প্রথম আলো: অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ১০০ দিন পূরণ হলো। সব দিক থেকে তাদের কাজকে কীভাবে মূল্যায়ন করছেন।
আনু মুহাম্মদ: নব্বইয়ের গণ–অভ্যুত্থানের সময় একটি পরিকল্পনা ছিল। তিন জোটের রূপরেখা ছিল। আমরা কোথায় যাচ্ছি, তা পরিষ্কারভাবে জানা ছিল। কিন্তু এবারের গণ-অভ্যুত্থানের সময় সরকার পতনের পর কী হবে, তার কোনো পরিষ্কার চিত্র ছিল না। তবে সমাজের মধ্যে একটা আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। সে আকাঙ্ক্ষার মূল কথাটা হচ্ছে, আমরা বিগত সরকারগুলোর মতো সরকার আর চাই না। এই আকাঙ্ক্ষাগুলো সারসংক্ষেপ করে একটি বাক্য জনপ্রিয় হয়েছে। সেটি হলো, ‘বৈষম্যহীন বাংলাদেশ চাই।’ বৈষম্যহীন বাংলাদেশ চাই এবং আগের মতো সরকার চাই না—এই পরিপ্রেক্ষিতকে বিচার করে অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ নির্ধারণ করার প্রয়োজন ছিল।
আমরা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক থেকে গত ৪ আগস্ট, শেখ হাসিনার পতনের আগের দিন একটি অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখা দিয়েছিলাম। সেখানে আমরা বলেছিলাম, হাসিনার সরকারের আর কোনো কার্যকারিতা নেই। কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। এখন একটি অন্তর্বর্তী সরকার আসতে হবে। গণতান্ত্রিক একটি রূপান্তর আনতে হবে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য কী কী করণীয়, সেখানে আমরা ব্যাখ্যা করেছিলাম। তারপর আমরা গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি থেকে ১৩ দফা দিয়েছি। অন্যদিকে সরকারের দিক থেকেও অনেক প্রতিশ্রুতি ছিল। গত তিন মাসে সরকার কিছু কাজ করেছে, যা করা উচিত ছিল। যেমন বেশ কিছু বিষয়ে কমিশন হয়েছে।
প্রথম আলো: কিন্তু এ সময়ে সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা কীভাবে নিরূপণ করবেন?
আনু মুহাম্মদ: আমরা জানি, আগের সরকারের মধ্যে লুটপাট ও সম্পদ পাচারের বড় প্রবণতা ছিল। ভয়ংকরভাবে ছিল। অভূতপূর্ব মাত্রায় লুটপাট হয়েছে। সেটি খতিয়ে দেখতে একটা কমিশন হয়েছে। নির্বাচন নিয়ে কমিশন হয়েছে। সংবিধান নিয়ে কমিশন হয়েছে। জ্বালানি-বিদ্যুৎ খাতে কী ধরনের অনিয়ম হয়েছে, তা দেখতে কমিশন হয়েছে। এসব কমিশন গঠন একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তারপর এই সরকার দায়মুক্তি আইন স্থগিত করেছে। সেটিও গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এরপর সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট বাতিল করার প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেছে। এগুলো ইতিবাচক কাজ বলে আমি মনে করছি। আবার এ সময়ে কিছু ক্ষেত্রে অনেকটা ১৯৭২ সালের মতো, কিংবা ১৯৯১ সালের মতো একধরনের আশাভঙ্গের মতো ব্যাপার ঘটেছে।
সরকারের ব্যর্থতার মধ্যে একটা হচ্ছে, এখন পর্যন্ত যারা জীবন দিল এবং যারা জখম হয়ে হাসপাতালে পড়ে আছে, তাদের তালিকা এই তিন মাসেও চূড়ান্ত হয়নি। বিভিন্নভাবে, বিচ্ছিন্নভাবে কিছু টাকাপয়সা দেওয়া হচ্ছে। আসলে তো এ বিষয়ে রাষ্ট্রকে দায়দায়িত্ব নিতে হবে। কারণ, এই গণ-অভ্যুত্থানে যারা নিহত হয়েছে, তাদের একটা বড় অংশ হচ্ছে শ্রমজীবী মানুষ। খেটে খাওয়া মানুষ। তাদের মধ্যে শিশু আছে। আবার শিক্ষার্থী পরিচয়ে যারা মারা গেছে, তাদের মধ্যেও অনেকে আছে, যারা শ্রমজীবী পরিবারের সন্তান। এর ফলে তাদের মৃত্যুকে শুধু তাদের মৃত্যু হিসেবে দেখল হবে না। এসব পরিবার ভয়ংকর বিপদের মধ্যে পড়েছে। অনেক পরিবার অস্তিত্বের সংকটে পড়ে গেছে। যারা আহত হয়েছে, অর্থাৎ যারা চোখ হারিয়েছে, হাত হারিয়েছে, পা হারিয়েছে, তাদের অনেকে এখনো হাসপাতালে পড়ে আছে। তাদের চিকিৎসার পয়সা নেই। অনেকে চিকিৎসা ছাড়াই বাড়িতে গেছে।
এটা তো সরকারের প্রথম দায়িত্ব ছিল—এদের তালিকা করা এবং এদের দায়িত্ব নেওয়া। এদের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য টাকাপয়সা নেই—এটা তো হতে পারে না। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়াও দুঃখজনক।