অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন ও জন আকাঙ্ক্ষা
অন্তর্বর্তী সরকারের একশ’দিন পূর্তি হয়ে গেল। দেশের বাইরে বর্তমান সরকারের ইমেজ কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন নামকরা পত্রিকায় খবর বের হতে দেখা যায়। একটি প্রতিবেশী দেশ বাদে অন্যান্য দেশের গণমাধ্যম অথবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ক্ষেত্রে সেটা অনেকাংশে প্রযোজ্য। অনেকে বলেন, সেটা নোবেল লরিয়েট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দরিদ্র বাঁচানোর অর্থনৈতিক দর্শন ও একান্ত ব্যক্তিগত ইমেজের কারণে বাংলাদেশের উপর বহির্বিশ্বের অনেকের কৌতূহলের কারণে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কিন্তু আশাবাদী জনগণের বর্তমান চিন্তা ও চাহিদার অতি রকমফের যেসব নিত্যনতুন সংকট সৃষ্টি করছে এবং সেগুলো পরিপূরণে ব্যর্থ হয়ে সরকারের সংগে যে জনদূরত্ব সৃষ্টি তা দেশের বাইরে থেকে অনুভব করার সুযোগ হয়তো তাদের কারুরই হয়নি।
ইতোমধ্যে দেশে ১১টি সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে। তারা মাঠে নেমে সংস্কার কাজের জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। কিন্তু জনগণের অনুভূত প্রয়োজন (ফেল্ট নিড) মেটানোর জন্য সংস্কার কাজ হাতে নেয়া হয়নি। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্তদের জন্য সরকারী সাহায্য, টেষ্ট রিলিফ, শহর কেন্দ্রিক টিসিবি-র কিছু ওপেন মার্কেট দিয়ে বিশাল সাহায্যপ্রার্থী জনগোষ্ঠীর মৌলিক চাহিদার অতি সামান্য অংশ সমাধান করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখাও ক্রমান্বয়ে কঠিন হয়ে উঠেছে।
একটি স্বতঃস্ফূর্ত ছাত্র-জনবিপ্লবের মাধ্যমে সৃষ্ট অন্তর্বর্তী সরকারের এক মাস না পেরুতেই পোশাক কারখানার শ্রমিকদের নিয়ে প্রতিবিপ্লব শুরু হয়েছিল। যেটা অদ্যাবধি এই সরকারে পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছে। কারণ এর লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের নিবিড় কাজ ও তাদের পোষ্যদের জীবন-জীবিকার সাথে দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক স্থিতিশীলতা বহুলাংশে জড়িত রয়েছে। রাজধানী ঢাকায় প্রবেশ ও বের হবার প্রধান সড়কগুলোর ধারে হাজার হাজার পোশাক কারখানা গড়ে উঠেছে। সেগুলোতে সামান্য কারণে যে কোন সময় অসন্তোষ লেগেই আছে। শ্রমিকদের বেতন বকেয়া রেখে কারখানায় তালা ঝুলিয়ে দিয়ে শ্রমিক অসন্তোষ সৃষ্টি করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করার প্রচেষ্টা আমাদের দেশের বহু পুরনো রোগ।
অন্তর্বর্তী সরকারের যাত্রা শুরু থেকে পোশাক শ্রমিকদের মাধ্যমে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করার প্রচেষ্টা দেশকে ধীরে ধীরে গভীর সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে। আমাদের গার্মেন্টস পাড়ায় চরম অস্থিরতা অবলোকন করে বিদেশী বায়ারগণ ভিন দেশে অর্ডার সরিয়ে নেয়া শুরু করেছেন। এটা আমাদের অর্থনীতিকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে। বলা হচ্ছে ফ্যাসিবাদের দোসররা এই ঘৃণ্য পন্থায় দেশকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করে সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করছেন। সেনাবাহিনীকে সেখানে দায়িত্ব দেবার পর পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও পুন:পুন: আন্দোলনের কৌশল পরিবর্তন করে কারখানা বন্ধ রাখায় শ্রমিকদের বেকারত্ম সৃষ্টি হচ্ছে। কোথাও কোথাও স্বল্পমজুরিতে কর্মরত হলেও তাদের বেতন ভাতা বন্ধ করে দেয়ায় চরম বিশৃংখলা সৃষ্টি হয়েছে।
আরেকটি বড় ক্ষেত্র হলো- বিগত স্বতঃস্ফূর্ত ছাত্র-জনবিপ্লবের সময় আহত-নিহতদের জন্য জন্য শক্তিশালী নীতি গ্রহণে ঢিলেমি করা। আন্দোলনের অব্যবহিত পরে সরকার গঠনের সাথে সাথে নিহতদের সাথে আহতেদের সঠিক পরিসংখ্যান তৈরীর ব্যবস্থা করার চিন্তা মাথায় আসেনি। বিগত আন্দোলনে কতজন কিভাবে আহত হয়েছিলেন তার কারণও জানা যায়নি। তাই ‘আনসার লীগের’ মতো তিনমাস পরে ‘আহত লীগের’ কথা উঠে এসেছে। ইতোমধ্যে জনপ্রিয় কিছু সমন্বয়কের বক্তব্যে ফুটে উঠেছে ‘আহত লীগের’ নামে চমকপ্রদ ভয়ংকর কিছু তথ্য।
একটি প্রথমসারির দৈনিক পত্রিকা লিখেছে, ‘আনসার লীগের পর এবার যে সরকার আহত লীগের খপ্পড়ে পড়েছে, এই ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের কথা আপনারা মানুষকে কেন জানাচ্ছেন না এখনো? আপনারা বারবার বলছেন, চিকিৎসা করেন, চিকিৎসা করেন, চিকিৎসা করেন। অসুস্থ মানুষের চিকিৎসা করা যায়। বাট সুস্থ মানুষ যখন রাস্তায় শুয়ে উপদেষ্টা হওয়ার দাবি করে, সেটার চিকিৎসা কী হবে?’ একজন আহত মানুষ কেন উপদেষ্টা হতে চাইবে বা একজন আহত মানুষ কিভাবে সারা দিন অনুষ্ঠান করে এসে রাতে হাসপাতালে ঘুমাবে, এই প্রশ্নটা কেউই করছে না।’ তবে ফ্যসিস্ট চরিত্রের প্রতারণার কত রকমফের হতে পারে- এ থেকে সবার শিক্ষা নেয়া উচিত।