শিল্পের চাহিদাকে বিবেচনায় নিয়ে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যক্রমে সংস্কার আনতে হবে
ড. তোফাজ্জল ইসলাম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক ও প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক। তিনি ২০০২ সালে জাপানের হোক্কাইডো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অ্যাপ্লায়েড বায়োসায়েন্সে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। জেএসপিএস, হুমবোল্ড্ট, কমনওয়েলথ ও ফুলব্রাইট ফেলোশিপের আওতায় জাপান, জার্মানি, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পোস্টডক গবেষণা করেছেন। আমেরিকান ফাইটোপ্যাথলজিক্যাল সোসাইটি, বিশ্ব বিজ্ঞান একাডেমি ও বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমির নির্বাচিত ফেলো। সম্প্রতি দেশের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যক্রমসহ উচ্চ শিক্ষা ও সমস্যা সমাধানভিত্তিক গবেষণার নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তায়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দিদারুল হক
খাদ্যনিরাপত্তাসহ একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারে?
দেশের খাদ্যনিরাপত্তায় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশেষ করে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। স্বাধীনতার সময় বাংলাদেশে প্রায় ২০ লাখ টন খাদ্য ঘাটতি ছিল। বর্তমানে মঙ্গা ও দুর্ভিক্ষ দৃশ্যমান নেই। যদিও অদৃশ্য ক্ষুধা এখনো রয়েছে। কৃষিজমি কমছে, জনসংখ্যা বাড়ছে এবং জলবায়ুর অভিঘাত কৃষিতে বিরূপ প্রভাব রাখছে। কাজেই বর্তমান ও ভবিষ্যৎ খাদ্যনিরাপত্তায় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা অতীতের চেয়ে অনেক বেড়েছে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা অনেক বাড়িয়ে ফেলা হয়েছে। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও সামর্থ্যের ঘাটতি থাকায় নব্য প্রতিষ্ঠিত কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মানসম্পন্ন ও দক্ষ কৃষিবিদ তৈরিতে হিমশিম খাচ্ছে। নেই পর্যাপ্ত গবেষণার সুযোগ-সুবিধা। আগে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা স্নাতক শেষ করেই চাকরি পেতেন এবং কোনো ধরনের প্রতিযোগিতা ছিল না। এখন সহস্রাধিক স্নাতক ডিগ্রিধারী বের হলেও সরকার শতাধিক ডিগ্রিধারীকেও চাকরি দিতে পারছে না। ফলে তারা বিভিন্ন সরকারি ক্যাডার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও চাকরি করছে। যেহেতু তাদের সাধারণ সামগ্রিক জ্ঞান (জেনেরিক নলেজ) অনেক বেশি, তাই তারা চাকরির প্রতিযোগিতায় যেকোনো পদে ভালো করেন। কারণ কৃষিতে স্নাতক ডিগ্রি মাল্টিডিসিপ্লিনারি, যা কোনো বিভাগ নয়, অনুষদ থেকে প্রদান করা হয়। কিন্তু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সবচেয়ে বড় লক্ষ্য দেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করা। সেখানে দুই ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা ও পাঠ্যক্রম রয়েছে। এর একটি নর্থ আমেরিকান শিক্ষা ব্যবস্থা ও পাঠ্যক্রম, যা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে। আরেকটি হচ্ছে, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএইউ) সিমেস্টারভিত্তিক পাঠ্যক্রম। নর্থ আমেরিকান পাঠ্যক্রমটি ট্রাইমিস্টার অর্থাৎ শিক্ষা বছর সামার, অটাম ও উইন্টার তিনটি টার্মে বিন্যস্ত। এ দুটো শিক্ষা ব্যবস্থা ও পাঠ্যক্রমের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। উভয় ক্ষেত্রেই পাঠ্যক্রম বর্তমানের বাস্তব চাহিদা অনুপাতে আধুনিকায়ন করা হয়নি। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাছে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর চাহিদা কী? শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো কোন পর্যায়ে রয়েছে, কোন প্রযুক্তিগুলো ব্যবহার করছে এবং চ্যালেঞ্জ কী? সেগুলো বিবেচনায় নিয়ে দেশের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে বড় ধরনের সংস্কার বা পরিমার্জন করা উচিত। এজন্য সরকার, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে একযোগে কাজ করা দরকার। সব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একই শিরোনামের বা মানের ডিগ্রির জন্য প্রয়োজনীয় কোর্সগুলো এবং ক্রেডিট সংখ্যায় একটি সামঞ্জস্য থাকা প্রয়োজন বলে মনে করি। কৃষি মূলত প্রায়োগিক বিজ্ঞান। সুতরাং সব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক শেষ বর্ষের শিক্ষার্থীদের ইন্টার্নশিপের ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষকের ফার্ম, এসিআই গ্রুপ, লাল তীর, ব্র্যাক, আরএফএলসহ যেসব বড় প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেগুলোয় ইন্টার্নশিপের সুযোগ তৈরি করতে হবে। ন্যাশনাল এগ্রিকালচারাল রিসার্চ সিস্টেমের কৃষি গবেষণাপ্রতিষ্ঠানগুলো, কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ ও বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) কৃষিসংশ্লিষ্ট সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি প্রকল্পে কৃষিতে স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করা বা ইন্টার্নশিপের ব্যবস্থা গ্রহণ করা সময়ের দাবি। ইন্টার্নশিপের মাধ্যমে তরুণ শিক্ষার্থীদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার সুযোগ দিয়ে চাকরিতে নিয়োগের জন্য যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তাছাড়া তরুণ উদ্ভাবক তৈরিকল্পে প্রতিটি প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ইনকিউবেশন হাব তৈরিসহ উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করতে হবে। কৃষি স্নাতকদের শুধু চাকরির জন্য তৈরি করা হচ্ছে, সে মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যক্রমে এমনভাবে পরিবর্তন আনতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে ওঠারও অপার সুযোগ থাকে। শিক্ষার্থীদের এমনভাবে তৈরি করতে হবে, যেন তারা পাস করে বের হওয়ার আগেই চাকরির বাজারে বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলো টেনে নেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- সংস্কার প্রস্তাব
- সংস্কার