প্রশাসনিক সংস্কারে ডিসিদের আপত্তি!
যেকোনো সরকারের অজনপ্রিয় তথা জনবিচ্ছিন্ন হওয়া এবং তার পরিণতিতে পতনের পেছনে আমলাতন্ত্রের বিরাট ভূমিকা থাকে। বিপরীতে সরকারের জনপ্রিয় হওয়ার পেছনেও প্রধান ভূমিকা রাখতে পারে তার প্রশাসনযন্ত্র। কেননা, সরকারের নীতি ও পরিকল্পনা এবং তার রাজনৈতিক কর্মসূচিগুলো মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়িত হয় প্রশাসনের লোকজনের মাধ্যমেই। এমনকি জনপ্রতিনিধিরা যেসব কাজ ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেন, সেখানেও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরাট ভূমিকা থাকে। যে কারণে আওয়ামী লীগের দুর্ভাগ্যজনক পরিণতির জন্য অন্য অনেক ফ্যাক্টরের সঙ্গে প্রশাসনের সেই সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকেও দায়ী করা হয়ে থাকে, যাঁরা পরপর তিনটি বিতর্কিত নির্বাচন অনুষ্ঠানে মাঠপর্যায়ে মূল ভূমিকা পালন করেছেন এবং রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ লোপাটে আইনি ও প্রশাসনিক ফাঁকফোকর তৈরি করেছেন।
প্রশাসনের লোকজনের ওপর সাধারণ মানুষের ক্ষোভের শেষ নেই। তার কারণ, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সেবা পেতে গিয়ে হয়রানি ও দুর্নীতির শিকার হননি, এ রকম লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন। সংগত কারণেই ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরে পুলিশ বাহিনীতে আমূল পরিবর্তন আনা হয়। একইভাবে প্রশাসনেও। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সংস্কারের জন্য ১০টির বেশি কমিশন গঠন করা হয়—যারা এখনো কাজ করছে। সাধারণ মানুষও একটা কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন চায়। জনবান্ধব পুলিশ ও মানবিক আমলাতন্ত্র চায়—যাতে যেকোনো সেবা পেতে গিয়ে তাকে হয়রানির শিকার হতে না হয়; ঘুষ দিতে না হয়; যে সেবাটি এক দিনেই পাওয়া সম্ভব, তার জন্য দিনের পর দিন ঘুরতে না হয়।
কিন্তু এটি হবে কী করে? মুখের কথায় সংস্কার হয় না। প্রধান উপদেষ্টা প্রশাসনের লোকজনকে ডেকে বলে দেবেন যে কাল থেকে কেউ ঘুষ খাবেন না, অনিয়ম করবেন না, দুর্নীতি করবেন না, জনগণের পয়সার নয়ছয় করবেন না—আর অমনি সবাই ফেরেশতা হয়ে যাবে, এটি ভাবার কোনো কারণ নেই। বরং এমন সিস্টেম গড়ে তুলতে হবে, যাতে কেউ ঘুষ খাওয়ার সাহসই না করে। সরকারি অফিসগুলোর সব কাজের সিস্টেম এমনভাবে ডিজিটালাইজড করে গড়ে তুলতে হবে, যাতে নাগরিককে যে সেবাটি এক দিনে দেওয়া সম্ভব, সেটি তিন দিন বা এক সপ্তাহ ঘোরানোর কোনো সুযোগই থাকবে না। এ জন্যই আসছে সংস্কারের প্রশ্ন। অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য যেসব কমিশন করেছে, তার অন্যতম জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। সম্প্রতি তাদের একটি সংস্কার উদ্যোগে ‘বাগড়া’ দিয়েছে প্রশাসন ক্যাডার।
‘ক্যাডার’ শব্দটি রাজনীতি ও প্রশাসন—উভয় ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। রাজনীতিতে ক্যাডার বলতে কখনো দলের সশস্ত্র মাস্তান অথবা দলের অগ্রগামী এমন কর্মীদের বোঝানো হয়—যারা দলের প্রয়োজনে প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়াই করতে প্রস্তুত। কিন্তু প্রশাসনে ক্যাডার বলতে বোঝানো হয় সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের। যেমন প্রশাসন ক্যাডার, পররাষ্ট্র ক্যাডার, পুলিশ ক্যাডার, তথ্য ক্যাডার ইত্যাদি। কিন্তু অনেকেই রসিকতা করে বলেন, প্রশাসন ক্যাডারের লোকজন এতটাই প্রভাবশালী যে তাঁদের কাছে রাজনৈতিক দলের ক্যাডাররাও নস্যি! জনপরিসরে এই ধারণাটি তৈরি হওয়ার পেছনে নানাবিধ কারণ রয়েছে।
প্রশাসনে যে আন্তক্যাডার বৈষম্য, তার পেছনেও প্রধানত ভূমিকা রাখে এই প্রশাসন ক্যাডার। বলা হয়, তারা অন্য সব ক্যাডারের ওপর ছড়ি ঘোরায় এবং পদোন্নতি ও পদায়ন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে সবচেয়ে বেশি। এ নিয়ে অন্য ক্যাডারের লোকজন তাদের প্রতি বেশ ঈর্ষান্বিতও থাকে। যে কারণে বিসিএস পরীক্ষায় চাকরিপ্রার্থীদের পছন্দের তালিকার শীর্ষে থাকে প্রশাসন ক্যাডার। কেননা এই ক্যাডারের লোকজন যত দ্রুত পদোন্নতি পান, অন্য কোনো ক্যাডারে সেটি সম্ভব হয় না। শিক্ষা ক্যাডারে তো নয়ই। উপরন্তু প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা পরিবার ও সমাজে যতটা ক্ষমতাবান হিসেব বিবেচিত হন, মূল্যায়িত হন; শিক্ষা, তথ্য এমনকি স্বাস্থ্য ক্যাডারের লোকও সেভাবে মূল্যায়িত হন না। একই মেধা ও যোগ্যতা নিয়ে দুজন দুই ক্যাডারে একই দিনে চাকরিতে যোগদানের পরেও দেখা যায়, প্রশাসন ক্যাডারের লোকটি যখন সচিব হলেন, অন্যজন হয়তো তখনো যুগ্ম সচিব বা তারও নিচের পদমর্যাদায় চাকরি করছেন। কোনো কোনো ক্যাডারে সচিবের মর্যাদা পাওয়ার আগেই তাঁদের অবসরে যেতে হয়।
প্রশাসন ক্যাডার থেকেই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগ হয়ে থাকে, যাঁরা প্রত্যেকে নিজ নিজ কর্মস্থলে একেকজন অলিখিত ‘জমিদার’। একটা সময় পর্যন্ত স্থানীয় সংসদ সদস্যদের তাঁরা সমীহ করতেন। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় তাঁরা ‘এমপিকেও গোনেন না’—এমন কথাও শোনা গেছে। অথচ ডিসি-ইউএনওরা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। জনগণের সেবক। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে কোনো ইউএনও বা ডিসি নিজেকে জনগণের সেবক বা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী (তাঁরা বলেন কর্মকর্তা এবং স্যার শুনে অভ্যস্ত) ভাবেন কি না—তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।