অসুস্থ কে—তোফাজ্জল না আমরা?
তোফাজ্জল আমাদের এই রাষ্ট্রের, এই কথিত সভ্য মানবসমাজের কেউ ছিলেন না বলেই আমরা তাঁকে নির্মমভাবে পিটিয়ে, তাঁর সমস্ত শরীর রক্তাক্ত করে হত্যা করেছি। তোফাজ্জল ছিলেন আপনজনহারা একজন মানুষ। তাঁর বাড়ি বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলার কাঁঠালতলী ইউনিয়নে। প্রেমঘটিত কারণে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। তাঁর বাবা দুর্ঘটনায় মারা যান ২০১৬ সালে, ২০১৯ সালে মা মারা যান ক্যানসারে। তাঁর বড় ভাই, যিনি একজন পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন, তিনিও ক্যানসারে মারা যান গত বছর।
মা–বাবা ও ভাই হারানোর পর তাঁর থাকা–খাওয়ার ঠিকঠিকানা ছিল না। কখনো বরগুনায় শুভানুধ্যায়ীদের বাড়িতে, কখনো ঢাকায় ভবঘুরে জীবন কাটাতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠেছিল তাঁর অস্থায়ী আস্তানা।
এ রকম একজন মানসিক রোগীকে আমরা কী ভয়ংকর হিংস্রতায় হত্যা করলাম!
অন্যান্য দিনের মতো বুধবারও তোফাজ্জল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে যান। ফজলুল হক হলের ছাত্ররা তখন মাঠে খেলছিলেন। খেলার পর কয়েকজন শিক্ষার্থী বললেন, তাঁদের মোবাইল চুরি হয়েছে। এরপর তাঁরা তোফাজ্জলকে সন্দেহ করেন এবং অতিথিকক্ষে নিয়ে গিয়ে মারধর করেন।
ফেসবুকে যেসব ছবি ভাসছে, তাতে দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় ছাত্রের মানসিক অসুস্থতাই উঠে এসেছে। তাঁরা এক দফা তোফাজ্জলকে মারলেন। তারপর তরকারি দিয়ে ভাত খেতে দিলেন। ভাত খাওয়ার পর আরেক কক্ষে নিয়ে আবারও মারলেন। মেঝেতে শুয়ে যখন তোফাজ্জল কাতরাচ্ছিলেন, তখন তাঁর হাত–পা, সারা শরীর রক্তাক্ত।
হল প্রশাসনের দায়িত্বরত শিক্ষকেরাও ছাত্রদের নিবৃত্ত করতে পারেননি। একজন শিক্ষক যখন তোফাজ্জলকে না মারতে অনুরোধ করেন, তখন ছাত্ররা বলেন, ‘আপনার ফোন চুরি হলে বুঝতেন।’
মার খেতে খেতে যখন তোফাজ্জল অচেতন হয়ে পড়লেন, তখনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাঁকে হাসপাতালে না নিয়ে থানায় নিয়ে গেল। থানা থেকে হাসপাতালে নেওয়ার আগেই সব শেষ।
তবে ছাত্ররা তোফাজ্জলকে মেরেই ক্ষান্ত হননি, তাঁরা এক পর্যায়ে তাঁর ফুফাতো বোন আসমা আক্তার তানিয়াকে ফোন দিয়ে বলেন, ‘তোফাজ্জল চুরি করতে এসে ধরা পড়েছেন, এখন ৩৫ হাজার টাকা পাঠিয়ে দিলে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হবে।’ তখন আসমা আক্তার তাঁদের অনুরোধ করে বলেন, ‘তোফাজ্জল মানসিক ভারসাম্যহীন, তাঁকে আপনারা মাইরেন না। সন্দেহ হলে থানা-পুলিশের কাছে দিয়ে দিন।’ আসমা থাকেন পিরোজপুরে।
মানসিক ভারসাম্যহীন তোফাজ্জল ছয়টি ফোন চুরি করেছেন, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। এরপরও যদি ধরে নিই তিনি চুরি করেছেন, তার জন্য তাঁকে খুন করতে হবে!
পাথরঘাটা উপজেলা চেয়ারম্যান এনামুল হোসেন বলেন, ‘বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় তোফাজ্জল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ঢুকে পড়লে রাত ৯টার দিকে একজন আমাকে ফোন দিয়ে বলেন, তোফাজ্জলের সঙ্গে কথা বলেন। তখন তোফাজ্জল হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলে, ভাইয়া, আমাকে বাঁচান। তখন আমি ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলি। তাঁরা বলেন, তোফাজ্জল ছয়টা মোবাইল চুরি করছেন, তার জরিমানা পাঠিয়ে দেন।’
সেই জরিমানা পাঠানোর আগেই ছাত্ররা তাঁকে পরপারে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
তোফাজ্জলের নিজ এলাকার প্রতিবেশী আরিফুজ্জামান ইমরান নিজের ফেসবুক ওয়ালে লেখেন, ‘বিগত দুই–তিন বছর তোফাজ্জল প্রায়ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াত। আমাদের এলাকার যারা ওরে চিনত, সবাই সহযোগিতা করত। ক্যাম্পাসে আমাকে দেখলেই দৌড়ে এসে কুশল বিনিময় করত। আমি দেখা হলে তাকে খাবার খেতে বলতাম বা খাওয়ার জন্য টাকা দিতাম অথবা ও মাঝেমধ্যে চেয়ে নিত। খাবার ও টাকার বাইরে ওর তেমন চাহিদা ছিল না।’