তত্ত্বাবধায়ক সরকার, না সুপ্রিম কাউন্সিল?
লিখতে চেয়েছিলাম শিক্ষার একটি সুনির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে। কিন্তু সম্প্রতি একজন সংবিধান বিশেষজ্ঞ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে সংবিধানে পুনঃস্থাপনের কথা উল্লেখ করায় প্রসঙ্গ পরিবর্তন করতে বাধ্য হলাম।
আমরা জানি, কোনো বিষয় বা ঘটনাকে প্রকৃতির নিয়মেই পূর্বাবস্থায় পেছনে ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। পেছনের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে পদ্ধতিকে আরও সমৃদ্ধ করে সময় ও ঘটনার গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সামনে এগিয়ে চলাই মানুষের ধর্ম। একেই বলে উদ্ভাবন। আমরা কেউই এর ব্যতিক্রম নই। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সুষ্ঠু নির্বাচন প্রয়োজন, মানি। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রয়োজন, এ কথাও মানি। বরং এ পত্রিকাতেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে অনেকবার লিখেছি।
সংবিধান সংশোধন বা পুনর্লিখন প্রসঙ্গে অনেক বিজ্ঞজন অনেক কথাই প্রতিনিয়ত বলছেন। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হলেই যে দেশের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, রাজনৈতিক বা রাজনীতি-পোষ্য খাদকগোষ্ঠীর চরিত্র পূত-পবিত্র হয়ে যাবে, এ কথা বিশ্বাস করা কঠিন। নির্বাচিত সরকার দেশ চালাবে সত্য। দেশটা ঠিকভাবে চলছে কিনা, তার দেখাশোনা করবে কে? এটাই না আসল কাজ! শুধু নিরপেক্ষভাবে ভোটের ব্যবস্থা করাই দেশের উন্নয়নের ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার একমাত্র উদ্দেশ্য কোনোক্রমেই হতে পারে না। শুধু ভোটের আয়োজনই একটা দেশের সবকিছু নয়, উন্নয়নের পূর্বশর্ত মাত্র।
প্রতিটি দলেই কিছু ভালো লোক এখনো আছেন, বাকিরা খাদকগোষ্ঠীভুক্ত। বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, একথা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন? এ অল্পসংখ্যক ভালো লোকের ওপর আমরা আস্থা রাখতে পারি না। কারণ আমরা জানি, তাদেরও বিশাল কর্মীবাহিনী ও বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকে নিয়ে চলতে হয়, তাদের চাপে হাত-পা-মুখ বাঁধা পড়ে থাকে; দল চালানো কঠিন হয়ে পড়ে, দলীয় কোন্দল দেখা দেয়। এদেশে চাটতে না দিলে ‘চাটার দল’ও সরে পড়ে। আমি অপ্রিয় বাস্তব ও সত্য কথা বলছি।
আমাদের দরকার শুধু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাই নয়, মূল উদ্দেশ্যের দিকে তাকানো। সেগুলো হলো, নির্বাচিত সরকারের পাঁচ বছর সময়ে কোষাগারের প্রতিটি টাকা যেন দেশ ও জনগণের কল্যাণে ব্যয় হয়, কোষাগারে যেন টাকাটা ঠিকমতো আসে, টাকা বানানোর জন্য কোনো মতলববাজ যেন রাজনীতিতে না ঢুকতে পারে, রাজনীতিতে টাকার খেলা বন্ধ হয়, প্রধানমন্ত্রীর পিয়নও যেন ৪০০ কোটি টাকার মালিক না হয়, আইন ও বিচার বিভাগকে অপরাধী যেন বুড়ো আঙুল দেখাতে না পারে, দলবাজ-সুবিধাবাদী লোক যেন অযথা গুরুর নাম-কীর্তন গেয়ে কাছে ভিড়তে না পারে, সুশিক্ষিত-নীতিবান লোক যেন রাজনীতিতে আসে, লাঠিয়াল বাহিনীর নেতা যেন রাজনীতির বড় পদ দখল করতে না পারে, রাজনীতি যেন সত্যিকার অর্থে দেশ ও সমাজসেবার জন্য হয়, দেশ যেন অদৃশ্য বহিঃশক্তির হাতে জিম্মি না হয় ইত্যাদি। ‘মুখে শেখ ফরিদ, বগলে ইট’ যেন না হয়। লক্ষ কোটি টাকা পতিত সরকারপ্রধান নিজে, নিজের আত্মীয়স্বজন, দলীয় লোকজন মেরেকেটে-শুষে রাষ্ট্রীয় কোষাগার ফাঁকা করে বিদেশে পাচার করে পালিয়েছে, এসব আমার-আপনার টাকা নয় কি?
আমরা সবসময় রাজনীতিকদের কুৎসাইবা রটাতে যাব কেন? তারা তো আমাদের শত্রু নন। তাদের রাষ্ট্রবিরুদ্ধ ও জনস্বার্থবিরুদ্ধ কর্মই না আমাদের তাদের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছে। তবে বলতেই হয়, বর্তমান রাজনীতিকদের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য ভালো নয়। এসবের জন্য প্রয়োজন রাজনীতিতে স্বয়ংক্রিয় ও স্বয়ংপ্রভ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা, যা আপনা-আপনি আসবে না। রাজনীতিকদের দায়িত্ববোধ ও জবাবদিহিতা ফিরিয়ে আনতে বাধ্য করা গেলে দুর্নীতিবাজ লোকজন রাজনীতি থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাবে। দেশ সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশ ফিরে পাবে; ন্যায়তন্ত্রের ধারাবাহিকতা সমাজে ফিরে আসবে।