গুম, নাগরিক অধিকার ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব
ধরুন, কোনো এক গভীর রাতে নিজের বাসায় ঘুমাচ্ছেন। হঠাৎ দরজায় শব্দ। খুলে দেখলেন কয়েক লোক। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিচয়ে আপনাকে বা পরিবারের কাউকে তুলে নিয়ে গেল। পরদিন আপনি থানা, পুলিশ সবখানে তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়ালেন। কিন্তু কোথাও আপনার সেই স্বজনকে খুঁজে পেলেন না। এটা কাল্পনিক গল্প নয়। গত দেড় দশকে বাংলাদেশে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে।
আপনি হয়তো কোনো রাজনৈতিক বা সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত; সাংগঠনিক বৈঠকে যোগ দিয়েছেন। হয়তো সাধারণ নাগরিক হিসেবেই ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে সামাজিক মাধ্যমে কিছু লিখেছেন। হয়তো সাংবাদিক হিসেবে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। বৈঠকে থাকতেই বা বাসায় ফেরার পথে অথবা মাঝরাতে বাড়ি থেকে আপনাকে তুলে নেওয়া হলো। এমনও অনেক ঘটনা গত দেড় দশকে ঘটেছে।
যেমন ঢাকার মিরপুরের ইসমাইল হোসেন বাতেন, পেশায় কাঠ ব্যবসায়ী। ২০১৯ সালে এক দিন দুপুরে কর্মস্থল থেকে নিখোঁজ হন। যেমন শিক্ষার্থী আবদুল কাদের মাসুম ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৬টায় টিউশনির কথা বলে ঢাকার নাখালপাড়ার বাসা থেকে বের হয়েছিলেন। বসুন্ধরা এলাকা থেকে মাসুমসহ আরও তিনজনকে র্যাব মাইক্রোবাসে তুলে নেয়। ২০২০ সালের ৩০ আগস্ট প্রকাশিত বিবিসির প্রতিবেদনমতে, সাত বছর পরেও তাদের খোঁজ মেলেনি।
২০১৭ সালের ৪ ডিসেম্বর সাবেক রাষ্ট্রদূত এম মারুফ জামানকে বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে তুলে নেওয়া হয়; ১৫ মাস পর খোঁজ মেলে। একইভাবে কবি ফরহাদ মজহার, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোবাশ্বার হাসান, সাংবাদিক উৎপল দাশকে তুলে নেওয়ার কয়েক দিন বা সপ্তাহ পর খোঁজ মিলেছে। কিন্তু গত দেড় দশকে এমন আরও অনেকে আর ফিরে আসেননি। তাদের মধ্যে যেমন সাধারণ নাগরিক রয়েছেন, তেমনি রয়েছেন বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর মতো ব্যক্তিও। মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’ বলছে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে ২০২৪ সালে ক্ষমতাচ্যুত হওয়া পর্যন্ত ৬ শতাধিক মানুষ নিখোঁজ হয়েছেন। তার মধ্যে ৮০টির বেশি লাশ পাওয়া গেছে।
আওয়ামী লীগ সরকার প্রধানত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের লক্ষ্যে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করলেও পুরো প্রশাসনিক কাঠামোতে এসব ঘটনার প্রভাব পড়েছিল। ব্যক্তি বা গোষ্ঠীগত বিরোধেও ব্যবহৃত হয়েছে এ হাতিয়ার। এ কারণে বাতেন কিংবা মাসুমের মতো কাঠ ব্যবসায়ী ও শিক্ষার্থীরা গুমের কবল থেকে রেহাই পাননি। প্রায় প্রতিটি ঘটনায় সরকার ও রাষ্ট্রীয় বাহিনী সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ করেছেন নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজন। আওয়ামী লীগের ক্ষমতাচ্যুতির পর বেরিয়ে আসছে এসবের প্রমাণ।
গুম বা নিখোঁজ ব্যক্তিদের উদ্ধারে বা খোঁজ জানতে সক্রিয় রয়েছে ‘মায়ের ডাক’ নামে একটি সংগঠন। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান আফরোজা ইসলাম বিবিসি বাংলাকে ২০২০ সালের আগস্টে বলেছিলেন, বিরোধী মত দমন করার জন্য সরকার গুমকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। গুম জনগণকে দমিয়ে রাখতে সরকারের কাজে লেগেছে।
বছরের পর বছর ক্ষমতাসীন দলগুলো রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবহার করে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মতো নির্মম ও অমানবিক ঘটনার জন্ম দিয়েছে। বিরোধী দল ও মত দমন, ক্ষমতার পাকাপোক্তকরণ, ত্রাস ও আতঙ্ক ছড়িয়ে জনগণকে জিম্মি করতে ক্ষমতাসীন দলগুলো এ পথ বেছে নেয়। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকার এই বেআইনি, নিষ্ঠুর ও অমানবিক পথেই হেঁটেছে। ৫ আগস্ট সরকার উৎখাতের পরপরই বহুল আলোচিত ‘আয়নাঘর’ থেকে গুম হওয়া কয়েক ব্যক্তি মুক্তিও পেয়েছেন।
গত দেড় দশকে বাংলাদেশে নাগরিক অধিকার কতটা তলানিতে নেমেছিল, তার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য হলো রাষ্ট্রীয় গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। রাষ্ট্রের কাছে একজন ব্যক্তির ‘নাগরিকত্ব’ পরিচয়টা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব হলো নিরাপদ ও সুন্দর জীবন নিশ্চিত করা। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় যাকে ‘গুড লাইফ’ বা সুন্দর জীবন বলা হয়েছে। এর মানে হলো, যেখানে অ্যারিস্টটলের ভাষায়– ন্যায়বিচার, কল্যাণ, জীবনে সৌন্দর্য ও উৎকর্ষ রয়েছে। এসব লক্ষ্যেই মানুষ সংঘবদ্ধভাবে বাস করে এবং রাজনৈতিকভাবে একতাবদ্ধ হয়। কিন্তু সেই রাষ্ট্রই যখন কাউকে গুম বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকারে পরিণত করে, তখন রাষ্ট্রের নৈতিক শক্তি ও অবস্থান বলে আর কিছু থাকে না।
- ট্যাগ:
- মতামত
- আন্তর্জাতিক গুম দিবস