চট্টগ্রাম বন্দরে বিশেষ গোষ্ঠী-সুবিধা বন্ধ হোক

যুগান্তর চট্টগ্রাম বন্দর সাকিব আনোয়ার প্রকাশিত: ২৪ আগস্ট ২০২৪, ১১:০৩

দেশে সাম্প্রতিক অস্থিরতায় ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন ও কারফিউ আরোপের কারণে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সার্বিক কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ায় অপারেশনাল প্রবাহে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। এ কারণে জেটিতে জাহাজের অবস্থান উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে জাহাজের অবস্থানের সময় ৪৮ ঘণ্টা হলেও বর্তমানে তা বৃদ্ধি পেয়ে গড়ে ৯৬ ঘণ্টায় দাঁড়িয়েছে। বন্দরের বহির্নোঙরে আগমনের পর গিয়ার্ডযুক্ত জাহাজ বার্থিংয়ের ক্ষেত্রে অপেক্ষমাণ সময় ১-২ দিন থেকে বেড়ে ৫-৬ দিনে দাঁড়িয়েছে, গিয়ার্ডবিহীন জাহাজ ২ দিনের জায়গায় ৭-৮ দিন বিলম্বের সম্মুখীন হচ্ছে।


‘বাংলাদেশ পতাকাবাহী জাহাজ (সুরক্ষা) আইন’ বলবৎ থাকায় বিদ্যমান জটিলতার মধ্যেও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ দেশের পতাকাবাহী জাহাজগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে চলেছে। ফলে এ বন্দরে আগত বিদেশি পতাকাবাহী জাহাজের বার্থিং কার্যক্রমকে বিলম্বিত ও বিঘ্নিত করে তুলছে। কেতাবি ভাষায় এ আইনকে দেশীয় মালিকদের সুযোগ তৈরির ব্যবস্থা বলে মনে হলেও এ আইন দ্বারা শুধু একটি বিশেষ গোষ্ঠীর মালিকানাধীন জাহাজগুলো একক ও বিশেষ সুবিধাভোগ করছে। বাংলাদেশ পতাকাবাহী জাহাজ (সুরক্ষা) আইন অনুযায়ী, একটি বার্থ বরাদ্দ করা হয়েছে কনটেইনারবাহী জাহাজের জন্য এবং অন্য বার্থ টি (শুধু জিসিবি জেটিতে) বরাদ্দ করা হয়েছে বাল্ক কার্গোর জাহাজের জন্য। পরবর্তীকালে ২০২২ সালে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ একটি সার্কুলারের মাধ্যমে জানায়, যদি কোনো বাল্ব কার্গো জাহাজ বহির্নোঙরে উপস্থিত না থাকে, তাহলে বিডি পতাকাবাহী কনটেইনার জাহাজ বাল্ব কার্গো জাহাজের বরাদ্দ করা জেটিতে বার্থ পাবে। উল্লেখ্য, বিডি পতাকাবাহী সব কনটেইনার জাহাজ গিয়ার্ড-লেস হওয়ায় সেগুলো চাইলেও জিসিবি জেটিতে বার্থ পেতে পারে না; ফলে বাংলাদেশের পতাকাবাহী দুটি কনটেইনার জাহাজকেই এনসিটি বা সিটিটি জেটিতে বার্থ দেওয়া হয়, যা বিদেশি পতাকাবাহী জাহাজের জন্য অপেক্ষার সময়কে আরও দীর্ঘ করে। দেশি পতাকাবাহী জাহাজগুলোর একটি বড় অংশের মালিক দেশীয় ব্যবসায়ীরা। মূলত বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ও সরকারের দু-একজন মন্ত্রী নিজেদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজ চালানোর বন্দোবস্ত করে নিয়েছিলেন। একই সঙ্গে বিগত সরকারসংশ্লিষ্ট এ গোষ্ঠীই নিজেদের স্বার্থে আইন প্রণয়ন ও পরবর্তীকালে সার্কুলারের মাধ্যমে মনোপলি ব্যবসার সুযোগ তৈরি করে নিয়েছেন। উল্লেখ্য, দেশীয় পতাকাবাহী এ গুটিকয়েক জাহাজ দেশের মোট আমদানি-রপ্তানি পণ্যের মাত্র ৮ থেকে ১০ শতাংশ পরিবহণ করে। বাকি ৯০ থেকে ৯২ শতাংশ পণ্য পরিবহণ হয় বিদেশি পতাকাবাহী জাহাজগুলোর মাধ্যমে। এ আইনের অধীনে বাংলাদেশের পতাকাবাহী (বিগত সরকারের অলিগার্ক গোষ্ঠীর মালিকানাধীন) জাহাজগুলোর অগ্রাধিকার বার্থিং দুই বছর ধরে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে এবং বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতিকে আরও তীব্র করছে।



বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজগুলোর বেশির ভাগই বিগত সরকারের একজন মন্ত্রী ও তার পরিবারের মালিকানাধীন, যারা পতাকাবাহী জাহাজ (সুরক্ষা) আইনের সুবিধাভোগী। তাদের মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠানের আটটি কনটেইনারবাহী জাহাজের প্রতিটিই গিয়ার্ড-লেস জাহাজ। যুক্তিসংগত হতো যদি এ আটটি কনটেইনারবাহী জাহাজগুলোর অন্তত ৫০ শতাংশ গিয়ার্ড হতো। কিন্তু বিশেষ সুবিধা নিয়ে তারা গিয়ার্ড-লেস জাহাজই পরিবহণ করছে।


এখানে পরিলক্ষিত হয়, যদি কোনো আমদানিকারকের কার্গো পোর্ট অব লোডিং থেকে বাংলাদেশে আমদানির উদ্দেশ্যে বিদেশি পতাকাবাহী জাহাজে পরিবাহিত হয়, তবে সেটি অন্য আমদানিকারকের যে কার্গোটি বিশেষ সুবিধা পাওয়া বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজে বাংলাদেশে আমদানি হচ্ছে, তার থেকে বিলম্বিত হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে খালাসের সুযোগ পাবে। যার ফলে বিদেশি পতাকাবাহী জাহাজে পরিবাহিত আমদানিকারক ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, কারণ তার আগেই বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজে করে পরিবাহিত কার্গোটির আমদানিকারক তার পণ্যটি বাংলাদেশের বাজারে বাজারজাত করতে পারছেন।


যেহেতু বিদেশি পতাকাবাহী জাহাজে আমদানিকৃত কার্গোগুলো চট্টগ্রাম বন্দরে বিলম্বে খালাস হচ্ছে, ফলে চট্টগ্রাম বন্দরে লং আইডল কনটেইনারের সংখ্যা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সুতরাং বিশেষ গোষ্ঠীর জাহাজগুলোকে বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ (সুরক্ষা) আইনের আওতায় এনে অগ্রাধিকার দেওয়া শুধু বিদেশি পতাকাবাহী জাহাজের মালিকদের জন্যই নয়, বরং একদিকে বাংলাদেশের সব আমদানিকারকের জন্য ব্যবসায়িক ক্ষতির কারণ এবং একই সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে।



রপ্তানি পণ্যের কাঁচামাল আমদানি বিলম্ব হওয়ায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে এবং রপ্তানির ক্ষেত্রে অন্যান্য রপ্তানিকারক দেশের চেয়ে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে হচ্ছে। বিশেষ করে, তৈরি পোশাক খাতে গোষ্ঠীকেন্দ্রিক এ বিশেষ ব্যবস্থা নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। আগেই উল্লেখ করেছি, দেশের আমদানি-রপ্তানির ৯০ থেকে ৯২ শতাংশ বিদেশি পতাকাবাহী জাহাজে পরিবহণ হয়। ফলে চাইলেই একজন আমদানিকারক তার পণ্য বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজে পরিবহণ করতে পারেন না। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) বহুবার চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমসংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে গার্মেন্টস পণ্যবাহী জাহাজগুলোকে এ পতাকাবাহী আইনের আওতাবহির্ভূত করার অনুরোধ জানিয়েছে।


চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বারবার চেষ্টার পরও বাংলাদেশ পতাকাবাহী জাহাজ (সুরক্ষা) আইন শিথিলের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি। চট্টগ্রাম বন্দরসংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, ২০২২ সালে দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজকে দুটি বার্থ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ব্যবহারের সুযোগ দিতে যে সার্কুলারটি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছিল, সেই সার্কুলারটি তৎকালীন একজন সংসদ সদস্য ও সদ্য সাবেক প্রভাবশালী মন্ত্রী চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের তৎকালীন চেয়ারম্যানকে রাজনৈতিক চাপে প্রকাশ করতে বাধ্য করেন। বন্দর কর্তৃপক্ষ আওয়ামী লীগ সরকারের অলিগার্ক গোষ্ঠীর একরকম হুমকির সম্মুখীন হয়েই এ সার্কুলারটি প্রকাশ করতে বাধ্য হয়।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও