রাজনৈতিক অর্থনীতির ক্রান্তিকাল উত্তরণে উদ্যম ও সাহস জোগাবে

বণিক বার্তা মোহাম্মদ আবদুল মজিদ প্রকাশিত: ০৯ আগস্ট ২০২৪, ১০:৪৫

বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি সংস্থার পরিসংখ্যানে পদ্ধতিগত কারণে স্বল্পমাত্রার ব্যবধান বরাবরই থাকে। জনসংখ্যা, খানা জরিপ, আমদানি-রফতানি, জিডিপি, রিজার্ভ, রেমিট্যান্স এমনকি রাজস্ব আয়ের তথ্যগত হিসাবেও টেকনিক্যাল ফারাক বা সীমাবদ্ধতা থাকে। কিন্তু মধ্যম আয়ের দেশের ট্র্যাপে পড়তে যাওয়া বাংলাদেশে জিডিপি, রফতানি, রিজার্ভ, রেভিনিউ ইনকামের মধ্যে তথ্যগত ফারাক ওরফে সমন্বয়হীনতা সেটা বাস্তবতার নিরিখে দেখা দরকার। বিশেষ করে রেভিনিউ আর্নিংয়ের হিসাবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের (সিজিএ) মধ্যকার অতি অস্বাভাবিক (সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরেও ৯৭ হাজার কোটি টাকার) পার্থক্যটা উদ্বেগজনক ও আত্মঘাতী তিন কারণে—(১) এনবিআরের রাজস্ব আহরণের তথ্যের সঙ্গে সিজিএর (বাংলাদেশ ব্যাংকে বা খাজাঞ্চিখানায় যা প্রকৃত জমা) হিসাব না মিললে তলাবিহীন ঝুড়ির সিনড্রোম ভেসে উঠবে, (২) নাসির উদ্দীন হোজ্জার স্ত্রী রান্না করা মাংস নিজে খেয়ে (দুর্নীতি) ফেলে বিড়ালের ওপর দোষ চাপানো, এই যদি বিড়ালের ওজন হয় তাহলে মাংস কই পরিস্থিতি নির্দেশ করবে, (৩) এনবিআরের আহরিত রাজস্বের হিসাবের ভিত্তিতে সর্বভুক অর্থনীতিতে ব্যয়ের বহর বাড়ালে পাছে টাকা লাগলে দেবে গৌরী সেন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে, গৌরী সেন তো নিজের পকেটের টাকা দেবে না, হয় চাহিদা মাত্র বাহককে দেয়ার দায়িত্ব পালনার্থে নিজ স্বাক্ষরে (ক্যাশলেসের স্লোগান দিয়েও) নগদ নোট ছাপিয়ে (এত সুন্দর প্রিন্টিং প্রেস আছে না!) নয়তো কঠিন শর্তের ধার-কর্জ করলেও (ভবিষ্যৎ অর্থনীতির সুদাসলের কিস্তির সুগার বা ডায়াবেটিস বাড়িয়ে হাইপো হলে ক্ষতি কী?) বর্তমানে মুচলেকা দানকারী খাতকের তাতে ব্যক্তিগত কিছু হবে না, ঋণভারে জর্জরিত হবে, মাজা ভেঙে যাবে ভবিষ্যৎ অর্থনীতির প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। 


১৯৮৬-৮৭ সালের কথা, আমি তখন আইআরডির সিএও (চিফ অ্যাকাউন্টস অফিসার), চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজে আহরিত বলে হিসাবায়িত ২ কোটি টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা না হলেও পার্টি আমদানীকৃত পণ্য ভুয়া চালান দেখিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে গেছে। কেন কীভাবে, কারণ কী? আমাকে তদন্ত করতে বলা হলো। থলের বিড়াল বের হলো। ব্যাংকের সিল ও সই জাল করা চালান কাস্টমস যাচাই করেনি। ২০ বছর পর আমি যখন এনবিআরএ চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দিই, বিষয়টি আমার মাথায় ছিল। দেখলাম, এনবিআর আয়ের তথ্যের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মেলানো হচ্ছে না। পার্থক্য নিরূপণ ও নিকাশের জন্য তখন বাংলাদেশ ব্যাংক, হিসাব মহানিয়ন্ত্রক ও এনবিআর এ তিন সংস্থার সমন্বয়ে মাস ভিত্তিতে হিসাব মেলানোর জন্য একটি কমিটি গঠন করে দেয়া হয়। মাসিক হিসাবের ক্ষেত্রে কিছু পার্থক্য থাকবেই। কিন্তু সেটা যেন নির্দিষ্ট মাত্রার বাইরে না যায়। আর যদি যায় সেক্ষেত্রে কী কী কারণে সেটা ঘটছে তা অনুসন্ধান করে পদক্ষেপ নিতে হবে। এভাবে চলছিল ঠিকই। কিন্তু ২০১০-১১ সালের দিকে সরকার রাজনৈতিক অর্থনীতি ফোলানো-ফাঁপানোর একটি কর্মপরিকল্পনা (ডকট্রিন) হাতে নেয়। সরকারের রিজার্ভ ও রফতানি আয়, জিডিপি ও রাজস্ব আয়ের আকার বড় করে দেখানোর দৃষ্টিভঙ্গি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। এ কারণে সরকার ২০১১ সালে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) পাঁচটি পুষ্টিকর প্রকল্প নেয়—(১) ডাটা কনভারশন, মেটা ডাটা প্রিপারেশন অ্যান্ড টাইম সিরিজ ডাটা কমপাইলেশন, (২) সার্ভিস অ্যান্ড স্টাডিস রিলেটিং টু জিডিপি রিবেসিং ২০১৫-১৬, (৩) ইমপ্রুভিং অব জিডিপি কমপাইলেশন অ্যান্ড রিবেসিং অব ইনডিসেস প্রজেক্ট, (৪) ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি ফর দ্য ডেভেলপমেন্ট অব স্ট্যাটিস্টিকস ইমপ্লিমেন্টেশন সাপোর্ট (এনএসডিএস), (৫) মডার্নাইজেশন অব ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টস স্ট্যাটিস্টিকস প্রজেক্ট নেয়া হলো। বাস্তবায়নে দেখা গেল, জিডিপি হিসাবায়ন ও প্রক্ষেপণ প্রক্রিয়াকে এমনভাবে পরিবর্তন করা হয়েছে যে তাতে অর্থনীতি তথা জিডিপিকে অনেকটা গরু মোটাতাজাকরণের মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। দেখা গেল জিডিপি, রিজার্ভ, রেভিনিউর আকার বড় দেখিয়ে বিদেশ থেকে বড় বড় ঋণ আনা হলো, বড় কাজের জন্য ঋণ নিতে সভরেইন গ্যারান্টিও দেয়া হলো, প্রচারের প্রগলভতায় উন্নয়ন বয়ানে রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের গ্রোথ দৃশ্যমান করা গেল। সুশাসনবঞ্চিত প্রচারসর্বস্ব উন্নয়নই ক্ষমতায় থাকার অবলম্বন সাব্যস্ত হয়ে গেল। ব্যাংকিং ও বিদ্যুৎ জ্বালানি খাত সিন্ডিকেটের হাতে বন্দিত্ব বরণ করায় অর্থ পাচার উদ্যোক্তা পাচার সবই সহজ হয়ে গেল। দেশে বিনিয়োগ করে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি না করে, দক্ষ জনবল গড়ে না তুলে বিদেশে বিনিয়োগের বাহাদুরি বেড়ে গেল। প্রকৃত আকারের চেয়ে জিডিপি, বাজেট ব্যয়, রিজার্ভ বড় দেখানোর মনোভঙ্গি প্রকাশ পাওয়ায় আয়ের সমবণ্টন হয়নি, উল্টো বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। কিছু মানুষের কাছে প্রচুর অর্থ আর অধিকাংশ মানুষের কাছে অর্থ নেই এমন অবস্থা তৈরি হয়েই তরুণদের মধ্যে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধে এবং এখন তা গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হওয়ার শানে নজুল এখানেই। 



জিডিপি, রিজার্ভ প্রবৃদ্ধি প্রদর্শনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে শনৈঃ উন্নতির দিকে দেখিয়ে শোষণ-বঞ্চনার উৎসব শুরু। ২০১১ সালে কর ন্যায়পাল অফিস বিলুপ্তকরণের মাধ্যমে এনবিআরকে জবাবদিহির ব্যাপারেও স্বাধীন এবং আরো স্বেচ্ছাচারী হওয়ার পথে উঠতে সহায়তা করা হয়। হিসাব মেলানো অগৌণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। 


এর ফলে কর-জিডিপি অনুপাত নিচে নামতে শুরু হলো। কারণ জিডিপির অনুপাতে কর আহরণ বাড়েনি। একদিকে জিডিপির হিসাবটি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি, অন্যদিকে যারা জিডিপিতে অবদান রাখছে, তারা করের আওতার বাইরে থেকে গেছে। কর প্রদানযোগ্য অধিকাংশ ব্যক্তির কাছ থেকে ট্যাক্স নেয়া হয় না। অবৈধ অর্থ উপার্জনকারীকে কোনো প্রশান করা হবে না বরং কর কম দিতে হবে এমন একটি অনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে, সে পরিবেশে মানুষ কর দেবে কেন? দেশের বড় মেগা প্রকল্পের জন্য বিদেশ থেকে যেসব জিনিসপত্র, পরামর্শক, দেশী-বিদেশী ঠিকাদার—শুরুতেই কর মওকুফ করে দেয়া হয়েছে। যদিও বিদেশীরা কর দেবে না, তাদের কর সরকারই দেবে। তবে উচিত ছিল সেসব করের হিসাব রাখা। প্রকল্পের প্রকৃত ব্যয় কত সেটা ঠিক না রাখলে রিটার্নের হিসাব ঠিকমতো পাওয়া যাবে না। প্রকল্পের খরচ থেকে সেই কর মাফ দেয়ায় সরকার একদিকে কর হিসাবভুক্ত করেনি, অন্যদিকে দেখানো হলো প্রকল্পে বেশি খরচ হয়নি। খরচ কম হয়েছে। আর্থিক অপচয়, আত্মসাৎ ও পাচার বাড়লেও প্রকৃত খরচ তো বেশি নয়। প্রকৃত হিসাব করা দরকার ছিল। প্রকৃত হিসাবটি অন্ধকারে রাখতেই সরকার আগেভাগেই কর মাফ করে দেয়। ফলে হিসাবায়নে এটি অস্বচ্ছতার অধ্যায়ের সূচনা হয়। যেমন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ইমিউনিটি দিয়ে দুর্নীতি বিস্তারের সুযোগ করে দেয়া হয়। এ কারণেও এখন কর-জিডিপির হিসাব মেলে না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের রাজস্ব পরিশোধের হিসাব অধরাই থেকে গেল। হিসাব মেলানোর তাগিদ ও যৌক্তিকতা অযৌক্তিক হয়ে দাঁড়াল। বাংলাদেশের মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এসব ব্যাপারে ও মৌনতা অবলম্বন কেন করলেন সেসব প্রশ্ন উঠবেই। 


২০১৪ সাল পর্যন্ত বাজেটের আকার মোটা দাগে সামঞ্জস্যের মধ্যে ছিল। সে সময় পর্যন্ত কোন কোন খাত থেকে বার্ষিক আয় কত হবে, সেই প্রাক্কলন সাধারণত এনবিআর নির্ধারণ করত। এর সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয় হয়তো ২-৩ শতাংশ বেশি লক্ষ্যমাত্রা দিত। ২০১৪ বা ২০১৫ সালের পর যখন সরকার জিডিপি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি দেখানো এবং বাজেটের আকার বড় দেখানো শুরু করে, তখন প্রতি বছরই বাজেট লাফিয়ে লাফিয়ে বড় হতে থাকে। আর ঘাটতির হিসাব মেলাতে গিয়ে তখন এনবিআরকে রাজস্ব আহরণের বড় লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ ওপর থেকেই আরোপিত। অভ্যন্তরীণ আয়ের উৎসের বড় অংশীদার এনবিআর। অর্থাৎ এনবিআর পারবে কি পারবে না সেটা বিবেচনায় আনা হয় না। 

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও