নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী প্রতারণা ও ভুলের পুনরাবৃত্তি হতে দেওয়া যাবে ন
লেখক ও গবেষক আনু মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়নবিরোধী নীতিমালা প্রণয়ন ও যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ মঞ্চে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। বর্তমানে ত্রৈমাসিক জার্নাল সর্বজনকথার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ও বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনেও নেতৃত্ব দিয়েছেন। বাংলাদেশ লেখক শিবিরের সাধারণ সম্পাদক (১৯৮৪-৯৩) এবং তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব (২০০৫-২০) হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
প্রবল পরাক্রমশালী শেখ হাসিনা সরকারের যে পতন হতে যাচ্ছে, সেটা কি ৫ আগস্টের আগে কোনোভাবে অনুমান করতে পেরেছিলেন?
আনু মুহাম্মদ: কোনো সরকারের পতন হচ্ছে কিনা, এর কিছু লক্ষণ রয়েছে। সবচেয়ে বড় লক্ষণ ছিল কোটা সংস্কার আন্দোলনে ব্যাপক জনসমর্থন। সরকার যত বল প্রয়োগ করেছে, আন্দোলনের কর্মসূচিতে জনসমাগম তত বাড়তে থাকে। আরেকটি লক্ষণ হলো, সমাজের বিভিন্ন অংশের সম্পৃক্ততা। আমরা দেখেছি, শিক্ষার্থীদের যখন দলে দলে হত্যা করা হচ্ছিল, তখন শিক্ষকরা, অভিভাবকরা, আইনজীবীরা, সাংবাদিকরা, শ্রমিকরা, শিল্পীরা, অভিনেতারা, ব্যাংকাররা দাঁড়াতে থাকল। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে, পেশাজীবী নির্বিশেষ সর্বস্তরের মানুষ যোগ দিচ্ছিল। পাবলিক ইউনিভার্সিটি, প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি একাকার হয়ে রাজপথে নেমে আসছিল। সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যাদের সাধারণত প্রতিবাদের মধ্যে প্রত্যক্ষভাবে দেখা যায় না, তারাও যখন রাস্তায় নামা শুরু করল, তখন স্পষ্ট হয়ে গেল যে, এই আন্দোলন আর পেছনে ফেরানো যাবে না। তখনই বোঝা গেল, মানুষের মধ্যে ব্যাপক সংহতি এবং সরকারের বিরুদ্ধে চরম বিদ্রোহ তৈরি হয়েছে।
ক্ষমতাচ্যুতির আগে সরকার তো বিভিন্ন বাহিনীর শক্তি প্রয়োগও করেছে যথেষ্ট।
আনু মুহাম্মদ: পুলিশ ও বিজিবি দিয়েও কাজ হয়নি। ব্যাপক হতাহতের পরও মানুষ দমে যায়নি বা সরে যায়নি। তারপর সরকার চূড়ান্ত শক্তি প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিল, কারফিউ দিল, সামরিক বাহিনীকে মাঠে নামিয়ে জরুরি অবস্থার মতো পরিস্থিতি তৈরি করল। কিন্তু মানুষ যখন কারফিউ ভেঙে রাস্তায় আসতে থাকল, তখন বোঝা গেল যে আর দমনপীড়ন করেও সরকারের পক্ষে পতন ঠেকানো সম্ভব হবে না। কারণ, সরকারের সর্বোচ্চ পদক্ষেপ ছিল কারফিউ দেওয়া, সেনাবাহিনী ডাকা। সেটা ব্যর্থ হওয়ার পর বিদায় ছাড়া তাদের আর কিছুই করার ছিল না। কারফিউ চলাকালেই আমরা বুঝতে পারি, শেখ হাসিনা আর থাকতে পারছেন না।
কারফিউ চলাকালেই ৪ আগস্ট প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষক নেটওয়ার্কের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক রূপান্তরের যাত্রার রূপরেখা দিয়েছিলেন আপনি। সেই রূপরেখা অনুযায়ী কি রূপান্তর প্রক্রিয়া চলছে?
আনু মুহাম্মদ: পরিস্থিতি এখন পর্যন্ত স্পষ্ট নয়। শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর রূপান্তর প্রক্রিয়ায় প্রথম বিচ্যুতি ঘটল সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নেওয়া ও আলোচনায় বসার ঘোষণায়। তিনি যাদের সঙ্গে আলোচনায় বসলেন, দেখা গেল, যারা মূল আন্দোলনের মূল শক্তি কিংবা যাদের নেতৃত্বে গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হলো, তাদের কেউ নেই। বরং এমন সব লোককে আলোচনায় ডাকা হলো, আন্দোলনে যাদের কোনো ভূমিকা নেই। বরং এমন লোকজনও আছে, যাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনবিরোধী ভূমিকার অভিযোগ আছে। আন্দোলনের মূল শক্তি আলোচনার অংশীদার না থাকায় একটা শূন্যতা তৈরি হলো। সেনাপ্রধানের কথা থেকেও বোঝা গেল, তারাও এমন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত নন; কোনো চিন্তাভাবনা করে আসেননি।
সেই শূন্যতা তো দ্রুতই পূরণ হয়েছিল।
আনু মুহাম্মদ: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের অনুপস্থিতিতে কয়েক ঘণ্টার শূন্যতার ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তী সময়ে সারাদেশে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতে থাকল। গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিটের বিরুদ্ধেই নানা তৎপরতা দেখা গেল। যেমন– সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর আক্রমণ, ভাস্কর্য থেকে স্থাপনা ভাঙচুর, আগুন কিংবা নির্বিচারে মানুষের ওপর আক্রমণ। এগুলো ঘটতে থাকল, কারণ সেনাসদরের আলোচনায় ছাত্র নেতৃবৃন্দের শূন্যতা ও নির্দেশনার অভাব ছিল। এই সমস্যাটা তৈরি হলো। এখন অবশ্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নেতৃবৃন্দ দৃশ্যপটে চলে এসেছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রূপরেখা দিচ্ছে। আর আমাদের রূপরেখাটি ছিল অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পরে সেই সরকারের করণীয় সম্পর্কে। সরকার গঠিত হওয়ার পর বোঝা যাবে, পরিস্থিতি কোনদিকে যাচ্ছে।