রপ্তানি তথ্য ‘সংশোধনে’ জোরালো হলো পুরোনো প্রশ্নটাই
আর্থসামাজিক পরিস্থিতি বুঝতে যেসব সূচক জরুরি, সে বিষয়ে সরকারি সংস্থা পরিবেশিত তথ্য-উপাত্ত নিয়ে সন্দেহ ছিল বরাবরই। সাম্প্রতিককালে এটা বাড়ছিল। শুধু দেশি-বিদেশি সংস্থা বা গবেষক পর্যায় থেকে নয়; খোদ সরকারের ভেতরেও এ নিয়ে বাড়ছিল মতপার্থক্য। কারণ এক সংস্থার তথ্যের সঙ্গে আরেক সংস্থার হিসাব মিলছিল না। এ নিয়ে প্রকাশ্যে বাহাস, এমনকি সংসদে মন্ত্রী পর্যায় থেকে সমালোচনা হতে দেখেছি। বিশ্বাসযোগ্য তথ্যের অভাবে পণ্যবাজার শান্ত করে আনার লক্ষ্যে পদক্ষেপ নিতেও সরকারকে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে দেখা গেছে নিকট অতীতে। গেল বছর সরকার প্রথমবারের মতো আলুর বাণিজ্যিক আমদানি অনুমোদন করে। এর আগ পর্যন্ত কৃষি মন্ত্রণালয় মানতেই চাইছিল না যে, দেশে আলুর উৎপাদন একটা পর্যায়ে এসে কমে গেছে। ব্যবসায়ীরা কিন্তু এটা ঠিকই বুঝতে পারছিলেন হিমাগারের একাংশ ফাঁকা দেখতে পেয়ে!
সাম্প্রতিককালে রপ্তানি বাণিজ্য যে সুবিধাজনক অবস্থায় নেই, সেটাও এ খাতের ব্যবসায়ীরা বুঝতে পারছিলেন নিজ ব্যবসায়িক পরিস্থিতি এবং একই খাতের অন্যান্য উদ্যোক্তার সঙ্গে নিত্যদিনের আলাপ দিয়ে। তারা দেখছিলেন, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) যে তথ্য দিচ্ছে, তার সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই। তারা বিভিন্ন ফোরাম, এমনকি টকশোয় এর প্রতিবাদ করছিলেন। রপ্তানি ঠিকমতো হলেও সে অনুযায়ী আয় আসছে না বলে তাদের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগও উঠছিল। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থ পাচারের সুযোগ তো রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের বিষয়টি হালে বেশ আলোচিতও বটে। কিন্তু ‘রপ্তানি তথ্য সংশোধনে’ বাংলাদেশ ব্যাংকের নজিরবিহীন উদ্যোগে বোঝা গেল, রপ্তানি আসলে বাড়িয়ে দেখানো হচ্ছিল এবং শেষ ক’বছরে এটা হয়ে ওঠে ভয়াবহ। এজন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও ইপিবি দুটোকেই কমবেশি দায়ী করে বলা হয়েছে, এখন থেকে তথ্য যাচাইপূর্বক সমন্বিতভাবে প্রকাশ করা হবে। গত নয়-দশ বছর ধরে কাজটি কেন অবহেলিত ছিল, তার সদুত্তর আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংককেও দিতে হবে বৈকি। ইপিবির সঙ্গে তার রপ্তানি তথ্যে অসঙ্গতি অব্যাহতভাবে বাড়তে দেখেও তারা এর কারণ অনুসন্ধানে মনোনিবেশ করলেন অনেক দেরিতে! এতে যা ক্ষতি হওয়ার, তা ইতোমধ্যে হয়ে গেছে।
এর আগে অত না হলেও গত দু’বছরে রপ্তানি তথ্যের অসঙ্গতিটা মারাত্মক। এতে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবং এর সঙ্গে তুলনা করে যেসব গুরুত্বপূর্ণ সূচকের হিসাব কষা হয়, সেগুলোও যাবে বদলে। কতটা বদলাতে পারে, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা বক্তব্য দিয়েছেন এর মধ্যে। এদিকে যাচাইপূর্বক পরিবেশন করবে বলে ইপিবি সদ্যবিদায়ি অর্থবছরের শেষ মাসের রপ্তানি তথ্য দেয়নি এ নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত। ‘ভুল তথ্য’ পরিবেশনের চেয়ে তা না দেওয়া অবশ্য ভালো। সেক্ষেত্রে অন্তত অপেক্ষা করে থাকা যাবে সঠিক তথ্যের জন্য। সঠিক তথ্য না পেলে তা থেকে ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার ঝুঁকিও বেড়ে যায়। রপ্তানিকারকদের পক্ষ থেকে যেমন বলা হচ্ছে, রপ্তানির অতিরঞ্জিত তথ্য দেখে সরকার বিভ্রান্ত হয়ে এরই মধ্যে কিছু পদক্ষেপ নিয়ে ফেলেছে। নতুন বাজেটেও নাকি সেটা প্রতিফলিত। তারা বলছেন, সঠিক চিত্র হাতে এলে সরকার অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি রপ্তানি খাতের প্রতি আরেকটু সদয় হতো। কিন্তু অতিরঞ্জিত তথ্যে সরকারকে তো এ ধারণাই দেওয়া হয়েছে যে, আমদানিকারক দেশগুলোয় নেতিবাচক পরিস্থিতি চলাকালেও আমাদের রপ্তানি ভালো। শুধু আয়টা দেশে আসা বেশি করে কমে যাচ্ছে!
রপ্তানি হলেও এর আয় সেভাবে প্রত্যাবাসিত না হওয়ার মানে ‘ডলার ইনফ্লো’ কমে যাওয়া। এতে একটা দেশে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ দুর্বল হওয়ার কথা। ওই একই সময়ে বাংলাদেশের রিজার্ভও কিন্তু কমছিল। আর সে দায়টা গিয়ে পড়ছিল রপ্তানিকারকদের ওপর! রিজার্ভ ক্ষয়ে যাওয়ার দায় প্রকৃতপক্ষে এর হেফাজতকারীদের। এখন তো এটা পরিষ্কার যে, দেশীয় মুদ্রা তথা টাকাকে শক্তিশালী দেখানোর চেষ্টায় ডলারের দাম আটকে রাখতে গিয়ে তারাই এ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছেন। পরবর্তীকালে ডলারের দু-তিনটি দাম সৃষ্টি হয় এবং বাজারের চাপে টাকার বড় অবমূল্যায়নে বাধ্য হন নীতিনির্ধারকরা। এতে বেড়েছে আমদানি ব্যয় এবং সে পথ ধরে অব্যাহতভাবে বেড়েছে মূল্যস্ফীতি। একই সময়ে বিশ্ববাজারে ডলারের দাম বাড়তে থাকায় দেশ থেকে ‘সস্তা ডলার’ পাচারের প্রবণতাও বেড়ে ওঠে। সম্প্রতি হঠাৎ করে রেমিট্যান্স যেভাবে বেড়েছে, তাতে অনেকে আবার আশঙ্কা করছেন পাচারকৃত অর্থ বিপুলভাবে দেশে ফিরে আসার। ডলারের দাম রাতারাতি সাত টাকা বাড়ানো; সঙ্গে কিছু প্রণোদনার ব্যবস্থা থাকায় এমনটা ঘটতেই পারে। এতে অর্থ সাদা করার সুযোগও হয়তো মিলছে! মাঝে যুক্তরাষ্ট্র হয়ে উঠেছিল রেমিট্যান্সের প্রধান উৎস; এখন ইউএই। বিধিবদ্ধ উপায়ে বেশি রেমিট্যান্স এলে তো ভালোই। তবে দেখা দরকার, কোন দেশ থেকে আর কেন এর আগমন বেড়ে গেল। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর এ বিষয়ক তথ্যানুসন্ধান জরুরি বৈকি।
রপ্তানিতে যারা আমাদের প্রতিযোগী, সেসব দেশের কোথাও কি এমনভাবে রপ্তানি বাড়িয়ে দেখানোর প্রবণতা রয়েছে? দুনিয়ার কোথাও কি ঘটেছে এটি? এর ‘ব্যাখ্যা’ দিয়ে অবশ্য বলা হয়েছে কী কী কারণে এমনটি ঘটেছে। কিন্তু বছরের পর বছর যাদের হাতে এটি ঘটেছে, তাদের কি জবাবদিহি করতে হবে না? যে ‘ভুলের’ কারণে এখন প্রবৃদ্ধির নতুন হিসাব করতে হবে এবং প্রাসঙ্গিক সব হিসাবও নতুনভাবে করাটা অনিবার্য-সেজন্য কি দায়িত্বশীলদের শাস্তি হওয়া উচিত নয়? অনেকে অবশ্য বলছেন, নির্বাহী বিভাগের ‘রাজনৈতিক ইচ্ছা’ বাস্তবায়নে তারা এমনটি করে এসেছেন কিনা! রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি দেখানো গেলে তো সামগ্রিক প্রবৃদ্ধিটা সহজেই বাড়ানো যায়। সংকটকালে, বিশেষত অন্যান্য দেশে প্রবৃদ্ধি কম থাকা অবস্থায়ও দেশে প্রবৃদ্ধি বেশি দেখানো গেলে ‘উন্নয়নের ভাষ্য’টি করে তোলা যায় জোরালো। কিন্তু প্রথমত রপ্তানিকারকদের প্রবল আপত্তি; দ্বিতীয়ত বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী, বিশেষত আইএমএফের অব্যাহত তাগাদায় এটা বের করে আনতেই হলো যে, রপ্তানি আসলে গেছে কমে।
এ অবস্থায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি এক শতাংশ কমলেও এর প্রভাব পড়বে অর্থনীতির অন্যান্য সূচকে। মাথাপিছু আয়ও যাবে কমে। এটা আরও কমতো, যদি করা হতো জনসংখ্যার গ্রহণযোগ্য হিসাব। এমন অভিযোগ তো জোরালো যে, জনসংখ্যা কমিয়ে দেখানো হয়েছে মাথাপিছু আয় বাড়াতে! জনসংখ্যা কমিয়ে দেখালে অবশ্য বিভিন্ন পণ্য ও সেবার প্রকৃত চাহিদা নিরূপণে সংকট দেখা দেয়। দেশে উপস্থিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ভোগচাহিদাও তো পূরণ করতে হচ্ছে ভেতর থেকে। তাদের সংখ্যাও কি সঠিকভাবে নিরূপিত? নিয়মিত চাহিদা মেটানোসহ সংকটময় পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার যে খাদ্য মজুত গড়ে তুলছে, সেটাও কি পরিবর্তিত সময়ের চাহিদা অনুযায়ী যথাযথ? প্রধান খাদ্যশস্য চাল উৎপাদনে অব্যাহতভাবে ‘লক্ষ্যমাত্রা’ ছাড়িয়ে যাওয়ার তথ্যও কি সঠিক? তাহলে বাজারে থেকে থেকে চালের দাম বৃদ্ধির প্রবণতা কেন? কেন গমসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য আরও বেশি করে আমদানি হচ্ছে, এমনকি ডলারের এত সংকট চলাকালে? কেনইবা হঠাৎ করে গেল অর্থবছরে গম আমদানি বেড়ে গেল এতটা? এক্ষেত্রে আবার আমদানি বেশি দেখিয়ে অর্থ পাচার হয়নি তো? এভাবে সন্দেহ পোষণের প্রবণতা এখন আরও বাড়বে, বিশেষত রপ্তানি তথ্য সংশোধনের ঘটনাটি ঘটার পর।