গম আমদানি বেড়ে যাওয়ার তাৎপর্য কী
২০২৪ সালে বিশ্বে গম উৎপাদন ১ শতাংশের মতো বাড়বে বলে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা যে প্রাক্কলন করেছে, সেটা আমাদের মতো গম আমদানিকারক দেশের জন্য সুখবর। বিশ্ববাজারে জরুরি এ খাদ্যশস্যের দাম সাম্প্রতিককালে কমে এসেছে উল্লেখযোগ্যভাবে।
এদিকে আমাদের গম আমদানি নতুন করে বাড়ছে। মাঝে তিন অর্থবছরে এটা অব্যাহতভাবে কমেছিল। গমের দাম অনেক বেড়ে যাওয়াটা ছিল এর একটা কারণ। আমাদের আমদানি সক্ষমতা কমে যাওয়াটাও এর কারণ ছিল বৈকি। গম থেকে তৈরি আটা-ময়দার চাহিদাও কমে গিয়েছিল। দুবছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি চলছে দেশে। এ অবস্থায় ভোগব্যয় হ্রাস এবং এর ধরনে পরিবর্তন আসাটাই স্বাভাবিক। তবে সদ্য বিদায়ি অর্থবছরে দেখা গেল, গম আমদানি বেড়েছে লাফ দিয়ে। ৬৮ লাখ মেট্রিক টন গম আমদানির খবর মিলল। পূর্ববর্তী অর্থবছরের তুলনায় আমদানি বেড়েছে ৭৬ শতাংশ। আর এটা হলো সর্বোচ্চ!
সরকারি এ তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে অবশ্য কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন-সম্প্রতি দেশের রপ্তানি তথ্য ‘সংশোধনের’ যে কাণ্ড হয়ে গেল, সেটা মাথায় রেখে। তবে বিধিবদ্ধ সংস্থা পরিবেশিত তথ্য ধরে আলোচনা করাটাই রীতি। গম আমদানির তথ্য অতিরঞ্জিত হলে সে বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন খাতসংশ্লিষ্টরা। বরাবরই এর আমদানির সিংহভাগ তো হয়ে থাকে বেসরকারি খাতে। বিপুল পরিমাণ গম ব্যবহৃত হয় আটা-ময়দা প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোয়। আর আটা-ময়দা বিপুলভাবে ব্যবহৃত হয় বেকারিশিল্পে। রেস্তোরাঁ খাতেও কম ব্যবহৃত হয় না। রেকর্ড আমদানির বিষয়টি তাদের বেশি অনুভব করতে পারার কথা। গম আমদানি বাড়ার সঙ্গে দেশে আটা-ময়দার দাম কমতেও দেখা যাচ্ছে। খোলা ও প্যাকেটে সরবরাহ করা উভয় আটা-ময়দার দামই কমবেশি হ্রাস পেয়েছে। তবে বিশ্ববাজারে গমের দাম যে হারে কমেছে, দেশে গম থেকে তৈরি পণ্যের দামে সেটা আনুপাতিকভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে না। এটি মূলত ঘটছে ডলারের দাম বাড়ার প্রবণতা অব্যাহত বলে। সম্প্রতি এর দাম আনুষ্ঠানিকভাবেই বাড়ানো হয়েছে একবারে ৭ টাকা। ‘অনানুষ্ঠানিক বাজারে’ দাম আরও বেশি। গমের মতো পণ্যসামগ্রী আমদানিকারদের অনেক সময় এ বাজার থেকেও বেশি দামে ডলার কিনতে হয়। অন্যান্য কারণেও, যেমন জ্বালানি ব্যয় অনেক বাড়ার কারণে শিল্প-বাণিজ্য পরিচালনার ব্যয় বেড়েছে। উদ্যোক্তাদের দিক থেকে বলা হচ্ছে, এসব কারণেই প্রত্যাশিত দামে পণ্যসামগ্রী বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না।
এ অবস্থায় ভালো হয় গম উৎপাদনকারী দেশগুলোয় এর আবাদ ও ফলন বাড়লে। দাম কম পাওয়ায় কোনো কোনো দেশে গমের আবাদ অবশ্য কমে যেতে পারে। তখনো হয়তো দেখা যাবে, হেক্টরপ্রতি ফলন বাড়ার কারণে সেখানে গম উৎপাদন অন্তত কমছে না। আবহাওয়া অনুকূলে থাকা-না থাকাটাও এর উৎপাদনকে প্রভাবিত করে বিপুলভাবে। এদেশে অবশ্য গম উৎপাদন কমই হয়ে থাকে। মাঝে এর উৎপাদন বেড়ে আবার কমে গেছে; যদিও চাহিদা ক্রমে বাড়ছে। গম তথা আটা-ময়দার ব্যবহার বাড়ছে ঘরে; এমনকি গ্রামাঞ্চলে। এ অবস্থায় ভালো হতো দেশে গমের উৎপাদন বাড়ানো গেলে। ২০ লাখ মেট্রিক টনের মতো গম উৎপাদন আমরা করতে পেরেছিলাম বলে তথ্য রয়েছে। সেটা কমতে কমতে ১০-১২ লাখ মেট্রিক টনে আটকে আছে কেন, তা সংশ্লিষ্টরাই ভালো বলতে পারবেন। এদিকে গেল অর্থবছরে আমদানি করতে হলো ৬৮ লাখ মেট্রিক টন গম। এর সঙ্গে দেশে ১০ লাখ মেট্রিক টন উৎপাদন হয়েছে ধরে নিলেও বুঝতে হবে গমের ব্যবহার কত বেড়েছে! এর মানে কি চাল পরিভোগ কমে যাওয়া? সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দেশে চালের উৎপাদন সন্তোষজনক। তারপরও চালের বাজারে থেকে থেকে দাম বৃদ্ধির প্রবণতা কেন, এর সদুত্তর পাওয়া কঠিন।
চালের দাম বাড়লেও গম আগের চেয়ে কমে পেলে অবশ্য কিছুটা ক্ষতিপূরণ হয়ে যাবে। আটা-ময়দার দাম হ্রাসের ঘটনায় কি এর সূত্রপাত হয়েছে? আটা-ময়দার দাম কমে এলে বেকারিপণ্যের দাম কিছুটা কমার কথা। বেকারিপণ্যের ওপর আমাদের নির্ভরশীলতাও দ্রুত বাড়ছে। গত এক দশকে আবার বড় বিনিয়োগ হয়েছে এ খাতে। পুরোনো কিছু কোম্পানিও রয়েছে সক্রিয়। এতে অবশ্য নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত যেসব ছোট ও মাঝারি বেকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল, সেগুলোর ওপর। কোভিডের দুই বছরেও এরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। বেশকিছু বেকারি বন্ধও হয়ে যায়। তা সত্ত্বেও বেকারিপণ্য উৎপাদন কমেছে বলে খবর নেই। এর অভ্যন্তরীণ বাজার বরং বাড়ছে উল্লেখযোগ্য হারে। কোভিডের সময়ও বড় বেকারিপণ্য উৎপাদনকারীদের বিক্রি বেড়েছিল। এদের হাত ধরে এ খাতে রপ্তানিও বেড়ে চলেছে। খবর আছে ২০-২৫ কোটি ডলারের বেকারিপণ্য রপ্তানির। এর বিরাট বিশ্ববাজারে এটুকু রপ্তানি অবশ্য কোনো খবর নয়। তবে আমাদের মতো নবীন বেকারিপণ্য উৎপাদকদের জন্য এটা বড় খবর। এটি বাড়িয়ে তোলার সম্ভাব্য সব সুযোগ নিতে হবে। রপ্তানিতে তৈরি পোশাকের ওপর বিপুল নির্ভরশীলতাও তো কমাতে চাইছি আমরা। তবে ছোট বেকারিগুলোকে রক্ষায় যা যা করার, সেটাও করতে হবে। কর্মসংস্থানের যুক্তিতেও এটা করা প্রয়োজন।