ধরা পড়া দুর্নীতিবাজ ও ঝরে যাওয়া নীতি
বর্ষায় মেঘভরা আকাশ থেকে যেমন কিছুক্ষণ পরপর বৃষ্টি ঝরে, তেমনি বেশ কিছুদিন ধরে দুর্নীতির ভারে ভারক্রান্ত দেশে দু-একটা করে খবর পত্রিকার পাতায় আসছে। এর মাধ্যমে মানুষ জানতে পাচ্ছে, পুলিশের কয়েকজন বড় কর্মকর্তা, রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তা কত কত সম্পদের মালিক বনে গেছেন। বড় কর্মকর্তারা বেশি বেতন পান এটা সবাই জানে। কিন্তু তা কি এত বেশি যে, শতকোটি টাকার মালিক হওয়ার মতো? তাহলে তাদের এই সম্পদের উৎস কী? আর অভিযুক্ত হলেই দেশ ছেড়ে তারা চলে যাচ্ছে কেন? এই প্রশ্নের একটাই উত্তর, সম্পদের উৎস দুর্নীতি আর সম্পদশালীদের পৃষ্ঠপোষক ক্ষমতা।
অন্যদিকে খবরে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরে ‘ঋণের সুদই দিতে হবে সোয়া লাখ কোটি টাকা’। গুণ ও ভাগ করে দেখা যাচ্ছে যে, দেশি ও বিদেশি ঋণের সুদ বাবদ পরিশোধ করতে হবে প্রতিদিন ৩৪২ কোটি টাকার বেশি। দেশের ১৭ কোটি মানুষকে জনপ্রতি প্রতিদিন কমবেশি ২০ টাকা করে সুদ শোধ দিতে হবে। যে শিশু আজকে জন্মেছে বা যিনি মৃত্যুপথযাত্রী তাকেও এই সুদের ঘানি টানতে হবে প্রতিদিন। আমাদের প্রতিটি শিশুই ঋণগ্রস্ত হয়ে জন্মগ্রহণ করছে আর প্রতিটি মানুষ ঋণের বোঝা মাথায় নিয়েই মৃত্যুবরণ করছেন। ঋণের সুফল না পেলেও দায় বহন করতে হচ্ছে তাদের। ঋণের টাকা ব্যবহৃত হয়েছে উন্নয়ন প্রকল্পে, যেখানে দুর্নীতির নতুন নতুন পদ্ধতি তৈরি হয়। ঋণের শর্ত হিসেবে বাড়ে জ্বালানি, বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম, বাড়ে রেলের ভাড়া, বাড়ে করের বোঝা। ফলে কিছু মানুষের দুর্নীতি অসংখ্য মানুষের দুর্গতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দেশে এখন চলছে আমলাদের দুর্নীতি নিয়ে আলোচনা। আড়ালে পড়ে যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফা ও সিন্ডিকেটের তৎপরতা। কোথায় নেই সিন্ডিকেট? আলু, পেঁয়াজ আর ডিমের সিন্ডিকেট নিয়মিত তৎপর। মাঝেমধ্যে চাল, কখনো কাঁচা মরিচ আর তার সঙ্গে সয়াবিন তেল, চিনি ও মুরগি সিন্ডিকেট তাদের ক্ষমতার জানান দেয়। মাংস উৎপাদনে নাকি বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিন্তু খাসি আর গরুর মাংস দাম ও দুষ্প্রাপ্যতার জন্য সাধারণ মানুষের খাদ্য তালিকা থেকে বাদ পড়ে গেছে কেন? মাংসের বাজারেও সিন্ডিকেট প্রবল। কিন্তু সিন্ডিকেটের প্রভাব বুঝতে পারলেও সিন্ডিকেট খুঁজে পাওয়া যায় না। তারা নাকি ধরাছোঁয়ার বাইরে। এর মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে নতুন সিন্ডিকেটের খবর। শ্রমিক পাঠানো নিয়ে ৪ সংসদ সদস্যের ব্যবসা নাকি রমরমা। পত্রিকার খবর অনুযায়ী, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারের চক্রে ৪ সংসদ সদস্যের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো গড়ে প্রায় ৭ থেকে ৮ হাজার অভিবাসী পাঠিয়েছে মালয়েশিয়ায়। নিয়ম অনুযায়ী জনপ্রতি অভিবাসন খরচ ৮০ হাজার টাকার নিচে। এই রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো সিন্ডিকেট করে প্রত্যেক মালয়েশিয়াগামী অভিবাসীর কাছ থেকে নিয়েছে পাঁচ লাখ টাকার বেশি! রেমিট্যান্স যোদ্ধারা যুদ্ধে যাওয়ার আগেই তাদের নিংড়ে নেওয়া হয়েছে।
কয়েক বছর আগে ক্ষমতাসীন দলের কিছু যুবনেতার ক্যাসিনো, জুয়া ও চাঁদাবাজি সূত্রে অর্জিত অবৈধ সম্পদ নিয়েও জিরো টলারেন্সের আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হয়েছে। গত দেড় দশকে শেয়ারবাজারেও অন্তত বার তিনেক বড় ধরনের কারসাজিতে একদিকে হা-হুতাশ, অন্যদিকে হুংকার শোনা গেছে। কিন্তু নিরীহ বিনিয়োগকারীদের সম্পদ নির্বিঘ্নে লুণ্ঠনকারীদের ধরা তো দূরের কথা, ছোঁয়াও যায়নি। ব্যাংকের টাকা ঋণের নামে জালিয়াতি করে আত্মসাতের ঘটনাও ভুলে যাওয়ার মতো নয়। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী ২০১২ সালে হল-মার্কের ৪ হাজার কোটি টাকার জালিয়াতির সমালোচনার জবাবে বলেছিলেন, ‘এটা কোনো বড় অঙ্কের অর্থ নয়।’ তার কথাকে তখন অবিশ্বাস্য মনে করেছিলেন অনেকে। কিন্তু এখন দুর্নীতির যেসব অঙ্ক বা তথ্য প্রকাশ পাচ্ছে, তাতে তার সেই কথাকে ভুল বা ঠাট্টা মনে করায় তারা লজ্জিত হতে পারেন। এখন নিয়ম ভেঙে যেমন ব্যাংক দখল, বেনামি ঋণে হাজার হাজার কোটি টাকা বের করে নেওয়ার নতুন নতুন দৃষ্টান্ত দেখে হতবাক হতেও ভুলে যাচ্ছে মানুষ। তবে দুর্নীতি নিয়ে মাঝে মাঝে যত শোরগোলই হোক না কেন, দুর্নীতিবাজদের কোনো সমস্যা নেই। দুর্নীতির গুরুতর অভিযোগের পর বদলি বা পদাবনতির মতো যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হয় তাতে মনে হয়, দুর্নীতি এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। পাপ টিকে থাক, পাপিকে সরিয়ে দাও এই নীতি চলছে।
অভিযুক্তদের আটকে রাখার ইচ্ছা নেই বলে ব্যাংক হিসাব থেকে টাকা উঠিয়ে নেওয়া বা সম্পদ জব্দের আগে তা হস্তান্তর করা ও বিদেশে পালিয়ে যেতে তাদের কোনো সমস্যা হয়নি। অতীতের ঘটনা দেখে এ কথা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, যদি তারা সরকারের সমালোচক বা বিরোধী দলের কেউ হতেন, তাহলে তাদের বিমানবন্দরের গণ্ডি পেরোনো সম্ভব হতো না। দেশে কেউ কি কখনো চেয়েছে যে, আমলারা দুর্নীতি করলেও তাদের বিচার কিংবা শাস্তি দেওয়া যাবে না। তারা কি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, তাদের অপরাধের দায়মুক্তি দিতে হবে? কিন্তু বিচার হবে এবং অপরাধের জন্য তাদের সাজা হবে, এমন আশা ও বিশ্বাস প্রায় হারিয়েই গেছে। কারণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর দলীয়করণের ফলে তারা রাজনৈতিক কর্র্তৃপক্ষ বা ক্ষমতাসীন দলের পৃষ্ঠপোষকতা ও আশীর্বাদ ভোগ করছে, যা তাদের করে তুলেছে দুর্বিনীত ও বেপরোয়া। যেমন শুদ্ধাচার পুরস্কারের কথা বলা যায়। দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রমের অংশ হিসেবে এবং সহকর্মীদের কাছে দৃষ্টান্ত স্থাপনের মতো কাজ করলে কেউ এই পুরস্কারের জন্য মনোনীত হতে পারেন। কিন্তু যিনি দুর্নীতিতে রেকর্ড গড়েছে সেও এই পুরস্কার তার ঝোলায় পুরেছে। কে বা কী প্রক্রিয়ায় তাকে মনোনীত করা হয়েছিল, তার দায়িত্ব এখন কেউ নেবে না। তাহলে কী এই ধারণা করা অমূলক হবে যে, ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন এবং একতরফা নির্বাচন আয়োজনে প্রশাসন ও পুলিশ কর্মকর্তাদের ভূমিকার স্বীকৃতি হিসেবে তারা বিভিন্ন পদক ও পুরস্কার পেয়েছে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- আমলা
- দুর্নীতিবাজ