প্রস্তাবিত বাজেট আশার আলো দেখাবে কি?
বাজেট বলতে আমরা কী বুঝি? অনেকের ধারণা, বাজেট মানে সংশ্লিষ্ট বছরের আয়ব্যয়ের হিসাবনিকাশ। আসলে বাজেট হলো একটি অর্থনৈতিক দর্শন, যে দর্শন দ্বারা পরবর্তী বছর রাষ্ট্রের উন্নয়ন ঘটার কথা। বলা বাহুল্য, অর্থনীতি সমাজের অন্যান্য কর্মকাণ্ডকে প্রভাবিত করে। ফলে বাজেট অর্থাৎ অর্থনীতির দর্শনটা যদি দূরদর্শী হয়, তাহলে দেশের উন্নতি হতে বাধ্য।
৬ জুন সংসদে প্রস্তাবাকারে উপস্থাপিত হতে যাচ্ছে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট। রীতি-রেওয়াজ অনুযায়ী, মাননীয় অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী সংসদে নতুন অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করবেন। বাজেটটি সংসদে উপস্থাপনের পর জনপ্রতিনিধিরা প্রায় তিন সপ্তাহ এর ওপর আলোচনা করবেন; কোনো কিছু সংশোধন-সংযোজনের ওপর গুরুত্ব দিয়ে মতামত রাখবেন। সার্বিক আলোচনা শেষে ওই মাসের শেষ সপ্তাহে তা চূড়ান্ত আকারে অনুমোদন দেবে সংসদ। পরবর্তী সময়ে এ বাজেটের কার্যকাল শুরু হবে ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে। তবে দীর্ঘ পাঁচ দশকের পর্যবেক্ষণ বলে, সংসদের আলোচনায় বাজেট প্রস্তাবনার খুব লক্ষণীয় পরিবর্তন দেখা যায় না। তাই প্রস্তাবিত বাজেটটিই চূড়ান্ত বাজেটের রূপ লাভ করে। তথ্য সরবরাহের যুগে মানুষকে বাজেট উপস্থাপনের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় না। এর আগেই গণমাধ্যমে বাজেট সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য প্রকাশিত হতে দেখা যায়। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। আগামী অর্থবছরের বাজেটের আকার কেমন হবে, কোন কোন খাতে কী ধরনের প্রভাব পড়বে প্রভৃতি বিষয় এরই মধ্যে গণমাধ্যমে উঠে এসেছে।
যে সময়ে নতুন অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপিত হতে যাচ্ছে, সেসময়ে সামগ্রিক অর্থনীতির অবস্থা খুব একটা সুখকর নয়। অর্থনীতির দু-একটি সূচক ভালোর ইঙ্গিত দিলেও বেশির ভাগ সূচকের অবস্থাই নাজুক। আমাদের বার্ষিক গড় প্রবাসী আয় কমবেশি ২২ বিলিয়ন ডলার হলেও ২০২৩ সালে তা কমতির দিকে ছিল। ২০২৪ সালে সেদিকটায় কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কর আহরণের দিকটাও কিছুটা ভালো। কিন্তু নেতিবাচক চিত্র হলো অর্থনীতির প্রধান চার খাতে। মূল্যস্ফীতি ক্রমাগত বাড়ছেই। ২০২২ সালে সার্বিক গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ, যা ২০২৩ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৯ দশমিক ২৪ শতাংশে এবং ২০২৪ সালের এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয় ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। অন্যদিকে টাকার মান পড়তির দিকে। টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বাড়ছেই। ২০২২ সালে ১ ডলার পাওয়া যেত ৮৭ টাকায়, ২০২৩ সালে ডলারের দাম বেড়ে হয় ১০৭ টাকা, আর বর্তমানে ডলারের বাজারমূল্য ১১৭ টাকা। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ তো আশঙ্কাজনকভাবে কমছে। ২০২২ সালের ৪২ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ ২০২৩ সালে কমে দাঁড়ায় প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলারে এবং বলা হচ্ছে ২০২৪ সালের মে মাসে প্রকৃত রিজার্ভের পরিমাণ ১৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি নয়। ব্যাংক খাতের অবস্থাও নাজুক। ব্যাংকের তারল্য কমে গেছে, ব্যাংকের ওপর মানুষের আস্থা গেছে হারিয়ে। কমপক্ষে তিনটি ব্যাংক আছে, যারা গ্রাহককে আমানতের টাকা ফেরত দিতে পারছে না, এমনকি কোনো কোনো ব্যাংকের কোনো কোনো শাখাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ব্যাংক একীভূতকরণের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে পুরো ব্যাংক খাতে। খেলাপি ঋণের পরিমাণও বছরওয়ারি বাড়ছেই। প্রতিবছরই গড়ে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। এর বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থার আভাস নেই। বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্রমাগত যে আঘাতের শিকার, তা হলো অর্থ পাচার। প্রতিবছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে যাচ্ছে, তা প্রতিকার ও প্রতিরোধের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না।
উল্লিখিত প্রতিকূলতাকে সামনে রেখেই ৬ জুন আসছে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের বাজেট। প্রত্যেক বাজেটেরই একটি আকর্ষণীয় প্রতিপাদ্য স্লোগান থাকে, সেই স্লোগানের বাস্তব চিত্র যাই হোক। এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে, ‘সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অঙ্গীকার’। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা। অর্থনীতির নাজুক অবস্থার মধ্যে অনেকের ধারণা ছিল আগামী অর্থবছরের বাজেটের আকার চলতি বাজেটের চেয়ে ৫-৬ শতাংশ কম হবে; কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, চলতি বাজেটের তুলনায় নতুন বছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার প্রায় ৪ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি; যা অঙ্কের পরিমাপে ৩৫ হাজার ১১৫ কোটি টাকা। এ বড় বাজেটে সবচেয়ে বড় চাপটি পড়বে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ওপর। সংস্থাটিকে আগামী অর্থবছরে রাজস্ব আহরণ করতে হবে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে কেবল করবাবদ আদায় করতে হবে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি বাজেটের তুলনায় ৫০ হাজার কোটি টাকা বেশি। অর্থনীতিকে গতিশীল রাখতে দুর্বল অর্থনীতির দেশগুলোয় সাধারণত ঘাটতি বাজেটের প্রস্তাব করা হয়ে থাকে। আমাদের দেশেও তা-ই। এবারের বাজেটে অনুদানসহ ঘাটতি থেকে যাবে ২ লাখ ৫৫ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকারও বেড়েছে। এবারে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। বাজেটের ঘাটতি মেটাতে সরকার ঋণের ওপর নির্ভরশীল হয়। ঋণের প্রধান দুটি উৎস হলো অভ্যন্তরীণ ব্যাংক ও বিদেশি ঋণ। সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে এ বছর কোনো ঋণ না নেওয়ার কথা ভাবছে সরকার। তবে ধারকৃত অর্থের বেশির ভাগটাই পড়বে দেশীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর। এবার সরকার আনুমানিক পৌনে ৩ লাখ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার কথা ভাবছে, যার মধ্যে দেড় লাখ কোটি টাকা নেবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে, আর বাদবাকি সোয়া লাখ কোটি টাকা নেবে বিদেশি উৎস থেকে।