বিদ্যুতের গ্রাহক ভোগান্তি: ম্যানুয়াল থেকে ডিজিটাল
একসময় বিদ্যুৎ গ্রাহকদের ভোগান্তির নাম ছিল ‘ভুতুড়ে বিল’। সে ছিল এক চরম ভোগান্তি, যাকে দুর্ভোগও বলা যায়। মোটামুটি ২০০০ সাল পর্যন্ত এই দুর্ভোগ বিদ্যুৎ গ্রাহকদের জীবনে জোরালোভাবেই বিদ্যমান ছিল। ওই সময় পর্যন্ত যাঁরা বিদ্যুতের গ্রাহক ছিলেন, তাঁদের মধ্যে এমন একজনকেও বোধ হয় খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি ওই দুর্ভোগের শিকার হননি। একেবারে অতিসাধারণ থেকে সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা পর্যন্ত কেউই সেই দুর্ভোগ থেকে রেহাই পাননি। তখনকার সংবাদপত্রের পাতায় প্রতিদিনই এ-সংক্রান্ত বেশ স্পর্শকাতর খবরাখবর থাকত।
অপ্রাসঙ্গিক নয় বলে এ রকম একটি খবর প্রকাশের বিষয় এখানে উল্লেখ করছি। ১৯৯৩-৯৪ সালের কোনো এক সময়ের ঘটনা। আমরা তখন ভোরের কাগজে কাজ করি। আরও কিছু বিষয়ের পাশাপাশি বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাত আমার কাজের ক্ষেত্র। একদিন জানা গেল, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) একটি বোর্ড সভার অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয় নির্ধারিত হয়েছে ‘ভুতুড়ে বিলের বিড়ম্বনা নিয়ে গ্রাহকদের অভিযোগ এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরাখবর সংক্রান্ত’। সভার তারিখ পরের দিনই। আরও জানা গেল, ভুতুড়ে বিলের বিষয়টি অত্যন্ত জনগুরুত্বসম্পন্ন হওয়ায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সচিব তৎকালীন মো. ফয়জুর রাজ্জাক সেই সভায় থাকবেন।
অফিসে এসে পরের দিনের অ্যাসাইনমেন্ট হিসেবে এটা লেখা হলো। একটু পরে আমার অনুজপ্রতিম ও স্নেহভাজন এক রিপোর্টার অফিসে এসে আমাকে বলল, আমার আপত্তি না থাকলে পরের দিন পিডিবির বোর্ড সভার নিউজটি সে কাভার করতে চায়। সে বোর্ডরুমের ভেতরে থেকে প্রত্যেকের কথা নিজের কানে শুনে রিপোর্ট করতে পারবে। বোর্ড সভায় সশরীরে থাকা আমার পক্ষেও অসম্ভব ছিল না। তবু আমি আপত্তি করলাম না। পরদিন যথারীতি সবার সঙ্গে সে-ও বোর্ডরুমে ঢুকে আসন নিল। বোর্ডরুমে তাঁকে চেনার মতো লোক ছিলেন দুজন। একজন মন্ত্রণালয়ের তথ্য কর্মকর্তা আব্দুস সাত্তার মিঁয়াজী। আরেকজন পিডিবির জনসংযোগ বিভাগের পরিচালক হাফিজুর রহমান। এই দুজনই বারবার তাঁর দিকে তাকান। সাত্তার মিঁয়াজী ভাবেন বোধ হয় হাফিজ সাহেব তাঁকে থাকতে বলেছেন। আর হাফিজ সাহেব ভাবেন যে তাঁকে বোধ হয় সাত্তার সাহেব নিয়ে এসেছেন।
এদিকে সভার কার্যক্রম চলছে। ভুতুড়ে বিলের বিষয়ে যখন আলোচনা শুরু হলো, তখন পিডিবির পক্ষ থেকে আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলা হলো—ভুতুড়ে বিল থাকলেও তা ততটা নয়, যতটা গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে। এরপর বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন সচিব ফয়জুর রাজ্জাক। তিনি সব সময়, সচিব হওয়ার পরও সরকারি বাড়িতে নয়, তাঁর পৈতৃক বাড়িতে থাকতেন। সেই বাড়ির যাবতীয় বিল তিনি নিজের তত্ত্বাবধানে যথাসময়ে পরিশোধ করতেন। পিডিবির বোর্ড সভায়ও তিনি এ তথ্য জানিয়ে ভুতুড়ে বিল সম্পর্কে তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে শুরু করেন। তিনি সেখানে বলেন, ওই সভার ঠিক আগের মাসে তাঁর পৈতৃক বাড়িতেও বিদ্যুতের একটি ভুতুড়ে বিল এসেছিল। সেটি নিয়ে তিনি নিজে পরিচয় না দিয়ে স্থানীয় বিদ্যুৎ অফিসে গিয়েছিলেন। সেখানে তাঁর কাছে সরাসরি ঘুষ চাওয়া হয় বিলটি সংশোধন করে দেওয়ার জন্য। এরপর নিজের কার্ড দিয়ে বাড়ির একজন কর্মচারীকে পাঠিয়ে বিলটি তাঁকে সংশোধন করাতে হয়েছিল।
পরের দিন ভোরের কাগজে ওই বোর্ড সভার বিস্তারিত বিবরণসহ সচিবের এ বক্তব্য প্রকাশিত হওয়ার পর যেন একটা লংকাকাণ্ড বেধে যায়। পিডিবির চেয়ারম্যান অফিসে এসেই জনসংযোগ বিভাগের পরিচালককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে চাকরি থেকে অপসারণের উদ্যোগ নেন। হাফিজ সাহেব আমাদের ফোন করেন, অন্যান্য পত্রিকায় তাঁর বন্ধুবান্ধব সিনিয়র সাংবাদিকদের জানান বিষয়টি। আমরা সচিবালয়ে যাই হাফিজ সাহেবকে রক্ষা করার জন্য সচিবের হস্তক্ষেপের প্রত্যাশায় এবং খুব সহজে তা হয়েও যায়। সে আরেক কাহিনি। আমাদের বিদ্যুৎব্যবস্থা তখন ম্যানুয়াল যুগে। গ্রাহক ভোগান্তির ওই সমস্যা ছিল ম্যানুয়াল যুগে।
এরপর ক্রমান্বয়ে আমাদের বিদ্যুৎব্যবস্থা উন্নত হতে শুরু করল। বিদ্যুৎব্যবস্থায় ডিজিটাইজেনের প্রক্রিয়া শুরু হলো। ভুতুড়ে বিল, সিস্টেম লস, বিদ্যুৎ চুরি বন্ধ করতে এবং একটি আধুনিক যুগোপযোগী বিদ্যুৎব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে আমরা ডিজিটাল পদ্ধতি প্রবর্তন করলাম। এ পথেই এল বিদ্যুতের প্রি-পেইড মিটার। এরপর দেখতে দেখতে আমরা স্মার্ট হওয়ার পথযাত্রা শুরু করেছি। কিন্তু গ্রাহক ভোগান্তি এখনো আছে এবং তা ম্যানুয়াল ভোগান্তি থেকে ডিজিটাল ভোগান্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- গ্রাহক ভোগান্তি
- ডিজিটাল
- মিটার
- ভুতুড়ে বিল