আরও দুর্দশার ভেতর দিয়ে যেতে হবে!
মূল্যস্ফীতি কমিয়ে দেখিয়ে তো লাভ নেই। যারা নিম্ন আয়ের মানুষ, তারা জানে মূল্যস্ফীতি কতটা। স্থির আয়ের মানুষও জানে। কারণ নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা তো আয় বাড়াতে পারে না। এ পরিস্থিতিতেও কিছু মানুষের আয় অবশ্য বাড়ে। মূল্যস্ফীতির চেয়েও বেশি হারে বাড়ে অনেকের আয়। মূল্যস্ফীতির আঁচ তাদের গায়ে লাগে না। তবে এটা তাদেরও সংকটে ফেলে, যারা আগে হয়ত কিছু সঞ্চয় করত। মূল্যস্ফীতির চাপে তারা আর আগের মতো সঞ্চয় করতে পারে না। জনগণের একটা অংশ সঞ্চয় ভেঙেও খেতে শুরু করে তখন। ব্যাংক থেকে অর্থ উত্তোলন বেড়ে যায়। সবচেয়ে নিরাপদ সঞ্চয় বলে বিবেচিত সঞ্চয়পত্র ভাঙিয়ে ফেলার প্রবণতাও দেখতে পাওয়া যায়।
দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি চলছে অনেকদিন ধরে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিবিএসের তথ্য মতেও মূল্যস্ফীতি এখন ১০ শতাংশের কাছাকাছি। চলতি অর্থবছরে আছে আর দেড় মাসের মতো। এ সময়ে মূল্যস্ফীতি কমবে বলে মনে হচ্ছে না। এটা বরং আরও কিছুটা বেড়ে যেতে পারে। এ অর্থবছরে যে প্রক্ষেপণ ছিল, তা থেকে অনেকখানি বেশিই থাকবে মূল্যস্ফীতি। আইএমএফসহ যেসব উন্নয়ন সহযোগী আমাদের অর্থনীতির সূচকগুলোর দিকে দৃষ্টি রাখে, তারাও বলছে, মূল্যস্ফীতি সহসা কমে আসার সুযোগ নেই। এরই মধ্যে নতুন পদ্ধতিতে গিয়ে একদিনে ডলারের দাম যেভাবে বাড়াতে হয়েছে, সেটা মূল্যস্ফীতিকে আরও চাগিয়ে দেবে বলেই মনে হচ্ছে। মুখে যা-ই বলা হোক, আমাদের অর্থনীতি তো আমদানিনির্ভর। যে পণ্যটি আমরা সবচেয়ে বেশি রপ্তানি করি, তারও কাঁচামাল ও পুঁজিপণ্য করতে হয় বিপুলভাবে আমদানি। এ খাতের উদ্যোক্তারা ডলারের নতুন দামে লাভবান হবে বটে; তবে তাদেরও আমদানি ব্যয় বেড়ে যাবে বেশি দামে ডলার কিনতে হওয়ায়। এক্ষেত্রে একটা ভারসাম্য হয়তো প্রতিষ্ঠিত হবে। তবে ব্যাপকভাবে আমদানিকৃত খাদ্যপণ্যের ওপর যাদের নির্ভর করতে হয়, ওই জনগোষ্ঠীর জন্য ডলারের দাম বেড়ে যাওয়াটা সাধারণভাবে দুঃসংবাদ। কর-শুল্ক কমানো না হলে খাদ্যপণ্য আমদানি ব্যয় এখন যাবে আরও বেড়ে।
অবশ্য বলা যেতে পারে, ডলারের আনুষ্ঠানিক দর ১১০ টাকা থাকলেও আরও ৫-৬ টাকা বেশি দিয়েই তো আমদানি করতে হতো। তা হতো বৈকি। তবে এরই মধ্যে খবর এসেছে, ব্যাংকে সব আমদানিকারক বর্ধিত দামেও ডলার পাচ্ছে না। খোলাবাজারেও এর দাম গেছে আরও বেড়ে। অনেক ক্ষেত্রে কিন্তু ব্যাংকের বাইরে থেকে ডলার সংগ্রহপূর্বক আমদানির ব্যবস্থা করতে হয়। অবশ্য আমদানির চাহিদা কমে আসতে দেখা যাচ্ছে অনেকদিন ধরে। এমনকি খাদ্যপণ্য আমদানি যাচ্ছে কমে। উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে নিত্যপণ্যের ভোগও কমে আসতে দেখা যায়। তখন ব্যবসায়ীরা কম আমদানি করে। তীব্র ডলার সংকট চলাকালে ওষুধের কাঁচামাল আমদানিও কমে গিয়েছিল। এর মধ্যে বেশকিছু ওষুধের দামও বেড়েছে নীরবে। এ সংকটে অনেক পরিবার শিক্ষা বাবদ ব্যয় হ্রাসে বাধ্য হলে সেটা হবে গভীরতর ক্ষতির কারণ। উচ্চ মূল্যস্ফীতি চলতে থাকলে মানবসম্পদ উন্নয়ন প্রক্রিয়া স্বভাবতই ব্যাহত হয়ে থাকে।
দেশে এখন বোরো উত্তোলন চলছে। সারা দেশেই যে এর উত্তোলন চলছে, তা কিন্তু নয়। অনেক স্থানে ধান উত্তোলন হবে কিছুটা দেরিতে। এ অবস্থায় কোথাও বৃষ্টি হলে ভালো; কোথাও না হলে। বিডিনিউজে এর আগে প্রকাশিত নিবন্ধে এ বিষয়ে কিছু আলোচনার প্রয়াস পেয়েছি। এ মুহূর্তে দেখার বিষয়— সামগ্রিকভাবে বোরো উৎপাদন পরিস্থিতি কেমন। একজন সিনিয়র কৃষি অর্থনীতিবিদ একটি সংবাদপত্রকে বলেছেন, তাপপ্রবাহে বোরোর উৎপাদন ৫০ লাখ টন কম হতে পারে। তিনি ধানের কথা বলেছেন; চাল নয়। তার আশংকা সত্য হলে ৩৫-৩৭ লাখ টন চাল কম মিলবে। দুই কোটি টনের কম চাল বোরো থেকে আসবে বলে রক্ষণশীল প্রক্ষেপণেও বলা হয়নি। সেখান থেকে ওই পরিমাণ চাল কম মিললে সেটা এর বাজারে কী প্রভাব ফেলবে, তা বিবেচনায় রাখা ভালো। শেষতক বৃষ্টিপাত অনুকূলে থাকলে এবং সেচ পরিস্থিতি বিপর্যয়কর না হলে উৎপাদন অবশ্য অত খারাপ হবে না। কথাটা তোলা হলো এটুকু বলতে যে, উচ্চ মূল্যস্ফীতি চলাকালে চালে আমাদের স্বস্তি যেন অটুট থাকে। নইলে চালও বেশি করে আমদানি করতে হবে। বিশ্ববাজারে এর দাম এখনও চড়া। আমদানির উৎসগুলোও নির্ভরযোগ্য নয়। এ অবস্থায় চালের দাম নতুন করে বাড়লে সেটা হবে বড় দুঃসংবাদ। গবেষণা সংস্থা বিআইডিএসের ডিজি সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, প্রতিটি জেলা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে তারা দেখেছেন, খাদ্য মূল্যস্ফীতি গত ডিসেম্বরে ছিল ১৫ শতাংশ। বিবিএস এটাকে ‘১২ শতাংশের কাছাকাছি’ দেখিয়ে ঠিক করেনি বলে তার মন্তব্য খবর হয়েছে। এতে আবারও বোঝা গেল, মূল্যস্ফীতি কমিয়ে দেখানোর একটা প্রবণতা রয়েছে। এ অবস্থায় বোরোর উৎপাদন মার খেলে সেটা যেন আবার গোপন করা না হয়। প্রকৃতির ওপর তো কারও হাত নেই। বিশেষত তাপপ্রবাহের ওপর। ধান-চাল উৎপাদনকারী গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াই তাপপ্রবাহে কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত। এ অবস্থায় আমরা কম ক্ষতিগ্রস্ত হলেই বাঁচি। তাতে চালের দাম নতুন করে বাড়ার প্রবণতায় না থাকলে বিশেষত খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতির প্রবণতাও কিছুটা কম থাকবে।