জলে জিম্মি স্থলে মুক্তি!
দস্যুতা, জিম্মি করা, পণে মুক্তিসহ জলের কায়কারবার অনেকটা বিশেষায়িত। এসব জানেন-বোঝেন কেবল সংশ্লিষ্টরা। বরাবরের মতো এবারও তা-ই হয়েছে। সোমালিয়ার উপকূলে জিম্মি ২৩ নাবিকসহ বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ ৩২ দিন পর মুক্তির পরতে পরতেও একই উপাখ্যান। জলদস্যু-কবলিত নাবিকসহ বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহর উদ্ধারের নেপথ্য খুঁটিনাটি জানেন জাহাজ মালিক, সরকার, দস্যু, উদ্ধার পাওয়া নাবিক আর মধ্যস্থতাকারীরা। জিম্মি নাবিকদের জাহাজে ছাগলের মাংস দিয়ে তেহারি খানাপিনা, নামাজ আদায়, ঈদ-নববর্ষ পালনের খবরাদি অন্যদের জন্য। হয়ে আসছে এভাবেই। সোমালিয়ায় জলদস্যুদের হাতে জাহাজসহ নাবিক জিম্মি-মুক্তি-উদ্ধারসহ যাবতীয় ক্রিয়াকর্ম সম্পাদন এবারও সেভাবেই হয়েছে।
চ্যাপ্টারটি আপাতত শেষ। ক’দিন বাদে এমন আরেকটি ঘটনা না ঘটা পর্যন্ত বিষয়টি আমরাও ভুলে থাকব। জলদস্যু মোকাবিলায় জাহাজগুলোতে কী ব্যবস্থা ছিল বা থাকে, কত পণে কোন রণে দফারফা হয়েছে তা সামনে আসবে না। মুক্তিপণের অঙ্ক সম্পর্কে মুখ না খোলাও একটি পণ বা শর্ত। এরা সবাই সবার জানাশোনা। নিজেরাই জলদস্যু নিজেরাই উদ্ধারকারী হওয়ার কাণ্ডকীর্তিও আছে। কেবল জলের দোষ নয়, স্থলেও কি ব্যতিক্রম? স্থলেও জলের জাহাজের মালিকপক্ষ এবং তদারকি সংস্থার মতো বাস-ট্রাকসহ পরিবহনকাণ্ড। বেশ মিল তাদের। উভয়ই ঠেকিয়ে ঠকায়। জ্বলে বা ভোগেন শুধু ভুক্তভোগী ও স্বজনরা। জাহাজি এ পেশা ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও কারও কারও মধ্যে এতে যুক্ত হওয়ার একটি ঝোঁক আছে। অবশ্য তারা বেশ লিমিটেড। তারা জানেন এ পেশায় নিরিবিলি অল্প সময়ে ভালো আয়-রোজগারের গোমড়। বিপদে পড়লে তখন বিশেষভাবে জ্বলতে হয় তাদের ও স্বজনদের। কেউ কেউ আবার বেশ অভ্যস্ত হয়ে গেছেন এ জ্বলা ও জ্বালায়।
জিম্মি বা অপহরণ জলে হলেও মুক্তিসহ যাবতীয় দেনদরবার ও ফয়সালা স্থলেই হয়। বাংলাদেশের কেএসআরএম গ্রুপের এই জাহাজ উদ্ধারে কীভাবে মুক্তিপণের অঙ্ক দস্যুদের হাতে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে, তা নাবিকরা জাহাজের ডেকে থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন। এমনই একজন নাবিক তার পরিবারের সদস্যদের জানিয়েছেন, ছোট উড়োজাহাজ থেকে জাহাজের পাশে ডলারভর্তি ব্যাগ ফেলা হয়। জাহাজের পাশে আগে থেকেই স্পিডবোটে করে অপেক্ষায় ছিল দস্যুরা। ডলারভর্তি ব্যাগ পানি থেকে সংগ্রহ করে দস্যুরা। এরপর প্রায় আট ঘণ্টা পর গভীর রাতে দস্যুরা জাহাজটি ছেড়ে যায়। আরেকজন নাবিকের বর্ণনা তুলে ধরে পরিবারের এক সদস্য গণমাধ্যমকে জানান, ডলারভর্তি ব্যাগ পানিতে ফেলার আগে নাবিকদের জাহাজের ডেকে নিয়ে এসে এক লাইনে দাঁড় করায় দস্যুরা। উড়োজাহাজ থেকে নাবিকদের প্রতি ইশারায় হাত তোলার ইঙ্গিত দেওয়া হয়। এরপর সব নাবিক হাত তোলেন। অর্থাৎ সব নাবিক জীবিত আছেন, এমন নিশ্চয়তা পাওয়ার পরই উড়োজাহাজ থেকে ডলার ফেলা হয়। তবে ব্যাগে কত ডলার ছিল, তা নিয়ে মালিকপক্ষ কোনো কিছু জানায়নি। মুক্তিপণের অর্থ পেয়েই দস্যুরা তাৎক্ষণিকভাবে জাহাজ থেকে নেমে যায়নি। মুক্তিপণের অর্থ পরিশোধের সময় জিম্মি জাহাজটির অদূরে ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ। আবার স্থলভাগে ছিল সোমালিয়ার পান্টল্যান্ড পুলিশের টহল।
১২ মার্চ মোজাম্বিকের মাপুতো বন্দর থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের আল হারমিয়া বন্দরে যাওয়ার পথে ভারত মহাসাগরে জলদস্যুদের কবলে পড়ে এমভি আবদুল্লাহ। জাহাজটি জিম্মি করার পর সোমালিয়ার গদভজিরান জেলার জেফল উপকূলের কাছে নিয়ে যায় দস্যুরা। ৯ দিনের মাথায় দস্যুরা প্রথম মুক্তিপণের দাবি জানায়। প্রায় দুই সপ্তাহ দর-কষাকষির পর মুক্তিপণের অঙ্ক চূড়ান্ত হয়। দস্যুরা নগদ ডলার ছাড়া নাবিকদের মুক্তি দেয় না। সে জন্য উড়োজাহাজে করে নগদ ডলার পৌঁছে দিতে হয় জিম্মি জাহাজের পাশে। আফ্রিকা অঞ্চলে এ রকম ছোট এয়ারক্রাফট পাওয়া যায়, যেগুলো খুব নিচু দিয়ে উড়তে পারে। এর আগে ২০১০ সালে ছিনতাই হওয়া একই কোম্পানির জাহাজ এমভি জাহান মণি ১০০ দিনের মাথায় ছেড়ে দেয় দস্যুরা। তখনকার প্রক্রিয়া বা পদ্ধতিও এমনই ছিল।
বছর কয়েক ধরে একটু দমলেও সম্প্রতি নতুন করে চটেছে সোমালীয় জলদস্যুরা। তা অভাবের তাড়নায় না তাদের বনেদি পেশার প্রতি চেতনা জেগে ওঠায় তা প্রশ্নবিদ্ধ। তবে, লোহিত সাগরে হুথিদের নিয়ে আন্তর্জাতিক বাহিনীগুলো বেশি ব্যস্ত থাকার সুযোগে ভারত মহাসাগরের গালফ অব এডেনে তারা আবার মাথাচাড়া দিচ্ছে বলে বিশ্লেষণ কারও কারও। ইতালিয়ান ঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে ১৯৬০ সালে সোমালিয়ার জন্ম। ১৯৯১ সালে সামরিক শাসনের উৎখাতের পরে নৈরাজ্য ভর করে দেশটিতে। পরের দুই দশকের বেশি সময় যুদ্ধবিগ্রহে বিধ্বস্ত সোমলিয়াতে কার্যকর কোনো সরকার ছিল না। ওই সময়টাতে আফ্রিকার মধ্যে দীর্ঘতম উপকূলসমৃদ্ধ দেশটির জলসীমার নিরাপত্তায় কোনো কোস্টগার্ড বা বাহিনী ছিল না।