-68757bc5c7319.jpg)
এখন প্রচলিত পদ্ধতিতে নির্বাচন হওয়া জরুরি
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলমান ছিল সজোরে। ছাত্র নিপীড়নসহ নিরপরাধ মানুষ হত্যার বিষয়টি বোধসম্পন্ন অনেকের কাছে ছিল স্পষ্ট। ৩১ জুলাই ২০২৪ আমরা প্রায় ৯০ শতাংশ শিক্ষক সম্মিলিতভাবে ছাত্র নিপীড়ন এবং নিরপরাধ মানুষ হত্যার বিচারের দাবিতে একসঙ্গে বলিষ্ঠভাবে দাঁড়িয়েছিলাম কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে। ৫ আগস্ট ভোর থেকেই একদফা আন্দোলনের খবর সংগ্রহ করছিলাম বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে। সময় যাচ্ছে আর ঢাকা মেডিকেল ও চানখাঁরপুল এলাকার গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম সরাসরি। সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন-এ সংবাদটি শুনেই এক দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে আশা রাখলাম। সত্যিই এদেশে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে, আশার আলো নিয়ে। সপরিবারে অপেক্ষা করছিলাম। ঠিক তখনই একটি হেলিকপ্টারের ভিডিও আমাদের অপেক্ষায় অন্ত টানল। ছেলেমেয়েকে বললাম, কাগজ-কলম দিয়ে বাংলাদেশের একটি পতাকা তৈরি করো। স্ত্রী, ছেলেমেয়ে আর হাতে বানানো জাতীয় পতাকা নিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে পড়লাম। পলাশী, শহীদ মিনার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও শাহবাগের চিত্র ছিল অবর্ণনীয়। ছাত্রসহ সব শ্রেণি-পেশা, ধর্ম ও বর্ণের মানুষের ঢল। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সক্রিয়তাও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণভাবে দেখা যায়। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার এক অনন্য অভ্যুত্থান প্রত্যক্ষ করলাম আমরা।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলো। মানুষের আশা, আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশা স্পষ্ট হতে থাকে। ১৩ আগস্ট ২০২৪ জাতীয় দৈনিকে একটি নিবন্ধ লিখে কিছু প্রস্তাবনা প্রকাশ করি, যা শুরুই হয় জাতীয় নির্বাচন দিয়ে-‘স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ প্রক্রিয়ায় নাগরিকদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল সরকারকেই এ দেশ পরিচালনার দায়িত্বে থাকতে হবে। তাই অন্তর্বর্তী এ সরকারকে বাংলাদেশে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনব্যবস্থা বা প্রক্রিয়া সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য সঠিকভাবে প্রয়োজনীয় সব সংস্কার করতে হবে। নাগরিক সমাজের কাছে যে কোনো নির্বাচিত সরকারকে তাদের কৃতকর্মের জন্য জবাবদিহির ব্যবস্থা আনয়ন করতে হবে।’
অভ্যুত্থান-পরবর্তী একটি সময়ে প্রথমেই ‘দেশ পরিচালনায় নির্বাচিত সরকার ও নির্বাচন ব্যবস্থা’র কথা কিছুটা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে, তবে তা ছিল যৌক্তিক ও প্রয়োজনীয়। বিতাড়িত অপশক্তির উত্থানের সঙ্গে অতীতের নির্বাচনব্যবস্থার ব্যর্থতা অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত ছিল। জাতীয় নির্বাচন একটি নতুন সরকার গঠনের প্রক্রিয়া হলেও বিগত সরকার আমলের নির্বাচনগুলো ছিল তৎকালীন সরকারের মেয়াদ বর্ধন তথা ধারাবাহিকতাকে বৈধতা দেওয়ার একটি পরিকল্পিত অপকর্মশালা। ভালো কাজের জন্য পুরস্কার আর অপরাধের জন্য থাকবে শাস্তি-এটি একটি সাধারণ মৌলিক নীতি। এ নীতি একদিকে মানুষকে ভালো কাজে উৎসাহিত করে, অপরদিকে আমাদের মন্দ থেকে বিরত রাখে। এটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। জনকল্যাণমুখী সরকারকে ভোটের মাধ্যমে নির্বাচনে বিজয়ী করে নতুন করে ক্ষমতায় নিয়ে আসা, আর অপশক্তিকে বিতাড়িত করা-এটিও একটি সাধারণ নির্বাচনি নীতি। সম্পূর্ণ নির্বাচনব্যবস্থাই ছিল লুণ্ঠিত ও ব্যর্থ। কাজেই সঠিক নির্বাচনি ব্যবস্থা/প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠিত/প্রয়োগ করে জনকল্যাণমুখী নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা করা হবে, এটাই অন্যতম প্রত্যাশা।
দেশ পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আর্থিক দুর্নীতির ধরন ও মাত্রা উন্মোচন করার উদ্দেশ্যে প্রণয়ন করা হলো বিশেষ শ্বেতপত্র, যা ইতিবাচক। অভ্যুত্থানের পক্ষে সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সমর্থন লাভও প্রশংসনীয়। সুনির্দিষ্ট খাত চিহ্নিত করে ১১টি সংস্কার কমিশনের মাধ্যমে সফলভাবে প্রয়োজনীয় সংস্কার সুপারিশ নেওয়া এ সরকারের উল্লেখযোগ্য অর্জন। সরকারের জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মধ্যস্থতায় বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সুপারিশ/প্রস্তাবনার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য বা সমঝোতা অর্জন একটি সফলতা। এ সফলতার অংশীদার রাজনৈতিক দলগুলোও বটে।
প্রজ্ঞা, মেধা ও উদ্যমের দৃশ্যমান উপস্থিতি রয়েছে অন্তর্বর্তী এ সরকারে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে সংশ্লিষ্ট নির্বাহী কর্তাব্যক্তি চেষ্টা করছেন। তারপরও নতুন বিনিয়োগে আশানুরূপ অগ্রগতি নেই। বিদ্যমান শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও প্রকল্পসমূহে রয়েছে বেশ অনিশ্চয়তা। স্বাধীন ও নির্ভরযোগ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, দেশে অর্থনৈতিক অগ্রগতির সার্বিক সূচক এখন নিুমুখী। সঙ্গে ‘মব ভায়োলেন্স’ ও সামাজিক সমস্যাও প্রকট। অর্থ উপদেষ্টা জানালেন, সরকার জাতীয় নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় ঘোষণা করায় দাতা প্রতিষ্ঠানসমূহ অর্থছাড় শুরু করেছে। বিদ্যমান সব পরিস্থিতির নির্মোহ পর্যালোচনা থেকে দৃঢ়ভাবে বলা যায়, দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য প্রয়োজন একটি ‘নির্বাচিত স্থিতিশীল সরকারব্যবস্থা’। এ ‘অন্তর্বর্তী’ প্রকৃতির সরকারব্যবস্থা দিয়ে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা আনা কঠিন। সংস্কার প্রস্তাবের যেসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য অর্জিত হয়েছে, তা সনদের মাধ্যমে সুনিশ্চিত করা প্রয়োজন। ঐকমত্যের এসব সংস্কার প্রস্তাবই বাংলাদেশ পুনর্গঠনের প্রাথমিক ভিত্তি হতে পারে। সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা নিয়ে দীর্ঘদিন চলার মতো শক্তি-সামর্থ্য বাংলাদেশের নেই। তাই আমাদের যাত্রা হওয়া উচিত নির্বাচিত রাজনৈতিক স্থিতিশীল সরকারব্যবস্থার দিকে। এ যাত্রা যত দ্রুত হবে, ততই কল্যাণকর।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে সম্প্রতি একটি ভিন্নমত এসেছে। পিআর বা সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে চলছে আলোচনা ও বিতর্ক। এ বিষয়ে যাওয়ার আগে প্রচলিত বর্তমান পদ্ধতি সম্পূর্ণভাবে জানা দরকার। জাতীয় সংসদ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইনসভা। এ আইনসভার জন্য জনগণের ‘সরাসরি’ ভোটে ৩০০ সংসদ-সদস্যকে নির্বাচিত করা হয়। এছাড়াও ৫০ জন মহিলা সংসদ-সদস্য সংরক্ষিত আসনের মাধ্যমে সংসদ-সদস্যরূপে মনোনীত হন। নির্বাচিত রাজনৈতিক দলের নেতাই হলেন সরকারপ্রধান বা প্রধানমন্ত্রী। তবে কোনো দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে তখন কোন দলের জোট থেকে কে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ পাবেন, তা রাষ্ট্রপতিই নির্ধারণ করবেন। রাষ্ট্রের প্রধান হলেন একজন রাষ্ট্রপতি, যিনি জাতীয় সংসদ কর্তৃক নির্বাচিত হন। এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয়, দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং সংরক্ষিত ৫০টি নারী আসনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে জনগণের সরাসরি কোনো অংশগ্রহণ নেই। দেশের জনগণের সরাসরি ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে একমাত্র ৩০০ আসনের নির্বাচনের ক্ষেত্রে। এ ৩০০ সংসদীয় আসনের ক্ষেত্রে জনগণ তাদের নিজ নিজ আসনের ‘প্রার্থী’ ও ‘দল’-উভয় বিবেচনায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ভোট প্রয়োগ করেন। অর্থাৎ বর্তমান পদ্ধতিতে দেশের জনগণের হাতে দলের পাশাপাশি উপযুক্ত জনপ্রতিনিধি পছন্দ করার সুযোগ আছে। বর্তমান পদ্ধতিতে দলের বাইরে পছন্দনীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীকেও ভোট প্রদান করার সুযোগ আছে। এটি জনগণের অধিকার বটে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- নির্বাচন ব্যবস্থা