মুজিবের সঙ্গে করমর্দন আইয়ুবের প্রথম পরাজয়
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রসঙ্গে আইয়ুব বলেছিলেন যে আগরতলা মামলা প্রত্যাহারের কোনো উপায়ই নেই, কারণ ওটি রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা। কিন্তু বাঙালি জাতীয়তাবাদ যে এক সময়ের ‘লড়কে লেঙ্গে’ পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের চেয়েও অনেক বেশি প্রবল হয়ে উঠতে পারে, এবং বলপ্রয়োগে দমন করতে গেলে তার প্রবলতা যে বাড়বে বৈ কমবে না, এই জ্ঞান রাষ্ট্রশাসকদের ছিল না। ফলে শেষ পর্যন্ত তাদের নতিস্বীকার করতে হলো। নতি নয়, পরাজয়ই। আগরতলা মামলা প্রত্যাহৃত হলো, শেখ মুজিবসহ মামলার সব অভিযুক্ত বেকসুর খালাস পেলেন এবং শেখ মুজিব বাঙালি জাতীয়তাবাদের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে বেরিয়ে এলেন। আইয়ুব খান গোলটেবিল বৈঠক ডেকেছিলেন। মুক্ত না হলে তিনি যোগ দেবেন না, মুজিব এই শর্ত দিলেন; আইয়ুব খান সেই শর্ত মেনে নিতে এবং গোলটেবিল বৈঠকে উপস্থিত ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ শেখ মুজিবের সঙ্গে করমর্দনে বাধ্য হলেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের কাছে এটি আইয়ুবের প্রথম পরাজয়। দ্বিতীয় ও শেষ পরাজয়টি ঘটল যখন তিনি বাধ্য হলেন পদত্যাগে। পুনরায় প্রেসিডেন্ট হওয়ার চেষ্টা করবেন না, অর্থাৎ নির্বাচনে দাঁড়াবেন না, এ রকমের ঘোষণায় কাজ হয়নি; তাকে প্রেসিডেন্টের পদই ছাড়তে হয়েছে।
আইয়ুব খানের ওই পরাজয়ের মূল কারণ পূর্ববঙ্গের আন্দোলন। বাঙালিরা পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের চূড়ান্ত ফয়সালা করতে চাচ্ছিল; যেটা আইয়ুবের বুনিয়াদি গণতন্ত্র ও পূর্ব-প্রতিষ্ঠিত সংখ্যাসাম্য নীতির কাঠামোর ভেতরে করাটা সম্ভব ছিল না। অমীমাংসিত জাতি সমস্যা অদমনীয় হয়ে উঠেছিল। পশ্চিম পাকিস্তানে অ-পাঞ্জাবিরা এক ইউনিট ভাঙার দাবি তুলেছিল; এবং আইয়ুব রাজি না হলেও তার উত্তরসূরি ইয়াহিয়া খান ওই দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। ইতিহাসের আরও একটি কৌতুক ঘটল; সেটা এই যে, যে-পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদকে শক্তিশালী করবার জন্য আইয়ুব খান চেষ্টা করছিলেন সেই জাতীয়তাবাদ তাকে সাহায্য করল না, বরঞ্চ জুলফিকার আলি ভুট্টো সেটিকে আরও উগ্র পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে আইয়ুব যে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের যথোপযুক্ত রক্ষক নন সেটা প্রমাণ করার জন্য তৎপর হলেন এবং কিছু পরিমাণে সাফল্যও পেয়ে গেলেন।
ভুট্টো জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সমাজতন্ত্রকেও মিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, ফ্যাসিবাদীরা যেমনটা করতে পছন্দ করে, এবং সে জন্য পশ্চিম পাকিস্তানে তিনি দ্রুত জনপ্রিয়তাও পেয়েছিলেন। আইয়ুবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে ১৯৬৫-এর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে তিনি অনেকটা উসকানিদাতার ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন, যুদ্ধে সুবিধাজনক ফল না পাওয়াতে পশ্চিম পাকিস্তানে যে হতাশার মনোভাব দেখা দিয়েছিল সেটিকে কাজে লাগাতে তিনি তৎপর হয়ে উঠেছেন। দেশে বেকারের সংখ্যা বাড়ছিল, স্বৈরশাসনের বাড়াবাড়িতে ছাত্ররা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল, ধূর্ত ও বক্তৃতাবাগীশ ভুট্টো তাদের অসন্তোষকে উসকে দিয়েছেন এবং নিজেকে জাহির করেছেন মুক্তির প্রতিশ্রুতিদাতা হিসেবে। ওদিকে মুজিবের ছয় দফার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে পাঞ্জাবি আমলা ও সেনাসদস্যের মধ্যে তিনি নিজের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করছিলেন। আইয়ুবকে হটিয়ে দিয়ে তার জায়গায় বীর হিসেবে জায়গা করে নেওয়াটা ছিল ভুট্টোর রাজনীতির অন্যতম অভিপ্রায়। মূল লক্ষ্যটা অবশ্য ছিল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাতে যাওয়া। এর জন্য যে কোনো পদক্ষেপ নিতে তিনি প্রস্তুত ছিলেন। প্রয়োজনে পাকিস্তানকে ভাঙতেও অসম্মত ছিলেন না পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের উচ্চকণ্ঠ এই প্রচারক। সত্তরের নির্বাচনের পর তিনি রাষ্ট্র ক্ষমতাকে পূর্ব পশ্চিমে ভাগ করে দেওয়ার দাবিও তুলেছিলেন। কোনো মতেই তিনি বিরোধী দলের নেতা হিসেবে আসন গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিলেন না; বাঙালি শেখ মুজিবের শাসনকে মেনে নিয়ে তো নয়ই। পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করার ব্যাপারে তার ভূমিকার সঙ্গে ব্রিটিশ শাসনের শেষ দিকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের হিন্দু মহাসভাপন্থিদের ‘জাতীয়তাবাদী’ তৎপরতার অনেকটা মিল দেখা যাচ্ছিল। ভুট্টোর তৎপরতা পূর্ববঙ্গে তো বটেই, পশ্চিম পাকিস্তানেও এক ইউনিটবিরোধী রাজনৈতিক মহলে শেখ মুজিবের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বলতা দিতে সহায়ক হয়ে উঠেছিল। আইয়ুব এক পর্যায়ে ভুট্টোকে আটক করেন, পরে আবার ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। কিন্তু রাজনৈতিক অঙ্গনে আইয়ুবের নতি স্বীকার ঘটে ভুট্টোর কাছে নয়, শেখ মুজিবের কাছেই। তিনি তাকে কেবল মুক্তি দেননি, গোলটেবিলে ডেকে তাকে স্বাগত জানিয়েছেন।
- ট্যাগ:
- মতামত
- আগরতলা ষড়যন্ত্র