‘আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না’
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি’- আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর অমর সৃষ্টি। যে গান বাঙালিকে সংগ্রামে এগিয়ে যেতে প্রেরণা দিয়েছে, আত্মপ্রত্যয়ী করেছে বারংবার। কিন্তু আশঙ্কার কথা, ভাষা সংগ্রামের ৭১ বছর পেরিয়ে সেই প্রেরণা আর আত্মপ্রত্যয় দিন দিন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। কালের পরিক্রমায় ভাষাসংগ্রাম ভাষা আন্দোলনে রূপান্তর হয়ে গিয়েছে। ভাষা দিবস, শহীদ দিবসে পরিণত হয়েছে, রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা অর্জনের আন্দোলন ভাষান্তরিত কিংবা বলা যায়, ভাবান্তরিত হয়ে মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার আন্দোলন হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। বিবর্তিত সময়ে পটপরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় ভাষা দিবসের পালকে নবতর সংযোজন ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি আদায়। যা জাতিকে দ্রোহের চেতনা থেকে সরিয়ে আনন্দে মশগুল করেছে। বারবার একুশে ফেব্রুয়ারির লক্ষ্য, চেতনা কিংবা স্বরূপ পরিবর্তন হলেও মাতৃভাষা হিসেবে বাংলার অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। জাতিকে স্বাধিকার ও স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে নিতে একুশের ভূমিকা যেভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে তার বিপরীতে বাংলা ভাষা ব্যবহারের অঙ্গীকার রক্ষার উদ্যোগ কয়েক যোজন দূরে রয়েছে। স্বাধীনতার ৫২ বছর পর এসেও দেখতে হচ্ছে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি। ভাষা সংগ্রাম, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, শিক্ষানীতি সবকিছুকে পাশে সরিয়ে রেখে ইংরেজি ভাষা দিনে দিনে বীরদর্পে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে। দেশে সচেতনভাবেই একটা ইংরেজি জানা অভিজাত শ্রেণি তৈরির প্রক্রিয়া চলমান। বিপরীতে বাংলা ভাষার অবস্থান; ’৫২-তেও এ ভাষা সাধারণ মানুষের ছিল, এখনো আছে এবং আগামীতেও থাকবে। আর এই ভাষাভাষী মানুষগুলো আজ দেশে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে রয়েছে, ভবিষ্যতেও থাকবে।
সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের ক্ষেত্রে যতই ভাষার দৈন্য, দুর্বলতাকে দায়ী করা হোক না কেন। দৈন্য ভাষার ছিল না, ছিল মানসিকতার। তাই ভাষা সংগ্রামের ৭১ বছর পরও দেখা যায়, আমাদের দার্শনিকরা মাতৃভাষায় নিজেদের মনোভাব প্রকাশ করতে পারেন না। আর নিজেদের অক্ষমতার দায় বিবেচনায় না নিয়ে মাতৃভাষায় পাঠ্যপুস্তকের অভাবকে সামনে দাঁড় করিয়ে দেন। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, যারা সর্বস্তরে বাংলা ব্যবহারের জন্য সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন, নিবেদিত হয়েছেন, নিজেরা পথিকৃৎ হয়েছেন তারা কিন্তু তাদের সন্তানদের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলেছেন। সাধারণ জনগণের জন্য যা মঙ্গলজনক তা তাদের সন্তানদের জন্য কল্যাণকর এ বিবেচনা তারা করতে পারেননি। একই মানসিকতার কারণে আমাদের উচ্চশিক্ষা ও উচ্চ আদালত বাংলা ব্যবহারের ক্ষেত্রে উদার নীল আকাশ দেখাতে সক্ষম হলো না। এ ব্যর্থতার দায়ভার দার্শনিকদের নয় শুধু, সরকার ও সংশ্লিষ্টদের দায়ও নেহাত কম নয়। প্রকৃত অর্থে এরা কেউই চায়নি দেশের শিক্ষা মানসম্পন্ন হোক। মাতৃভাষা ছাড়া শিক্ষা যে পূর্ণতা পায় না, তা বিশ্বাস করার পরও নিজেদের অভিজাত শ্রেণিভুক্ত রাখতে সাধারণ জনগণের জন্য মিথ্যা আস্ফালনই করে গিয়েছে আন্তরিকভাবে কোনো প্রচেষ্টা গ্রহণ করেননি।
স্মৃতিভ্রমের মিছিলে বাঙালি প্রথম যা ভুলে গিয়েছে তা হচ্ছে প্রভাতফেরি। বিজাতীয় শাসনামলে রাতের আঁধারে সম্মিলিতভাবে অস্থায়ী বেদী তৈরি করে, প্রতিবেশীদের বাড়ি থেকে ফুল সংগ্রহ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হতো। পরবর্তী সময়ে একটা নির্দিষ্ট বেদি হলে সেখানে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ দলবদ্ধভাবে খালি পায়ে দেশাত্মবোধক গান গাইতে গাইতে শ্রদ্ধা নিবেদন করত। স্বজাতির শাসনে শহীদ বেদি স্থায়ী রূপ পেল, দিবসটি তাৎপর্যপূর্ণ অবয়ব পেল। কিন্তু অতীত ঐতিহ্যের শ্রদ্ধা নিবেদন আন্তরিকতা হারিয়ে প্রতিযোগিতার মানসিকতায় অবতীর্ণ হলো। আর এখন তো অনেকে জুতা পরেই বেদিতে ওঠে এবং পছন্দের ফুল নিয়ে নির্বিঘ্নে নেমেও আসে। যদিও বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে না তারপরও এসব দৃশ্য দেখে মনে হয়, বাঙালি হয়তো ঐতিহ্য ভুলে যাওয়ার চেয়ে প্রতিবাদহীন দর্শকে পরিণত হয়ে গিয়েছে অধিকমাত্রায়। যদি কোনো কারণে একান্ত বাধ্য হয়ে প্রতিবাদ করতে এগিয়ে যেতেই হয়, তবে সেক্ষেত্রে এক এবং একমাত্র কর্মসূচি থাকে মানববন্ধন।
- ট্যাগ:
- মতামত
- বাংলা ভাষা
- বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন