পাকিস্তানের ভুল থেকে বাংলাদেশের শিক্ষণীয়
পাকিস্তানের ৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন নিয়ে চরম নাটকীয়তা চলাকালীন কলামটি লিখছি। পাকিস্তানের অর্থনীতি দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত বন্ধু চীন এবং সৌদি আরবও এখন আর পাকিস্তানের ভিক্ষাবৃত্তির ভার নিতে নারাজ। পাকিস্তানের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ভয়ানক লোডশেডিংয়ের শিকার হচ্ছে অহরহ। পাকিস্তানি রুপিতে ডলারের দাম নাটকীয়ভাবে বেড়ে এক ডলার এখন ২৯০ রুপিতে বিক্রি হচ্ছে। পাকিস্তানি অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি সমস্যা ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছে গেছে। এক কেজি আটার দাম ১৬০ রুপি ছাড়িয়ে গেছে। এক কেজি চিনির দাম ৩০০ রুপির বেশি। পাকিস্তান যে ক্রমেই অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে ডুবে যাচ্ছে, তার প্রধান কারণ সাড়ে পাঁচ লাখ সেনাসদস্যসহ সাত লাখের একটি সশস্ত্র বাহিনীর বোঝা বহন করা পাকিস্তানের পক্ষে কোনো যুক্তিতেই সম্ভব নয়, যদিও জন্মশত্রু ভারতের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য এত বড় সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলেছে তারা। কিন্তু এই বিশাল সশস্ত্র বাহিনী পোষার খেসারত হলো, বাংলাদেশের জন্মের আগেই পাকিস্তান রাষ্ট্রটির প্রকৃত শাসনক্ষমতা ১৯৪৮-৫৮ পর্বে পর্দার আড়াল থেকে এবং ১৯৫৮-৭১ পর্বে সরাসরি সামরিক এস্টাবলিশমেন্টের করতলগত হয়ে গিয়েছিল।
বাংলাদেশ অংশ হারানোর পর ১৯৭১-২০২৪ পর্বেও কিছুদিন পরপর সামরিক একনায়করা পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করছেন। আবার যখন কিছুদিনের জন্য সামরিক বাহিনী সিভিলিয়ান শাসকদের কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন, তখনও শাসন ক্ষমতার প্রকৃত লাগাম নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে দিয়েছেন তারা। ২০১৮ সালে ইমরান খান নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হয়েছিলেন সামরিক বাহিনীর মদদেই। কিন্তু সাবেক সেনাপ্রধান কামার বাজওয়ার সঙ্গে ক্ষমতার দ্বন্দ্বের জেরে ২০২২ সালে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল সামরিক এস্টাবলিশমেন্ট। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইমরান খানের ২৪ বছরের জেলদণ্ড এবং ৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে নওয়াজ শরিফকে আবার ক্ষমতায় বসানোর জন্য নির্বাচনকে ম্যানিপুলেট করার পেছনেও একই মহলের হাত রয়েছে। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফল জানাচ্ছে, পাকিস্তানের জনগণ প্রধানত ইমরানের পেছনে থাকায় এই ষড়যন্ত্র ভণ্ডুল হওয়ার উপক্রম।
১৯৪৮ সাল থেকেই পাকিস্তান সরকারের বাজেটের প্রধান খাত হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রতিরক্ষা। কিন্তু প্রতিরক্ষা ব্যয়ের অসহনীয় বোঝা যে পাকিস্তানের অর্থনীতিকে ‘মেল্টডাউনের গিরিখাত’-এ ধাবিত করছে– সেই সত্যটা বিশ্বের সামনে নগ্নভাবে উদ্ভাসিত। বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম জনসংখ্যা অধ্যুষিত দেশ পাকিস্তানের জনসংখ্যা দ্রুতগতিতে বেড়ে এখন ২৩ কোটিতে পৌঁছে গেছে; যাদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার জোগান দেওয়া এত বড় সশস্ত্র বাহিনীর খাঁই মেটানোর পর কোনোমতেই সম্ভব হচ্ছে না। দেশটির বার্ষিক রপ্তানি আয় এখনও ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচে রয়ে গেছে। অথচ আমদানি ব্যয় ৮০-৯০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যাচ্ছে প্রতিবছর। প্রতিরক্ষা খাতের বিপুল ব্যয় বরাদ্দ মেটানোর পর জনগণের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের ন্যূনতম প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহ করা সরকারের সাধ্যের বাইরেই থেকে যাচ্ছে। ফলে এ দুটো খাতে পাকিস্তান ক্রমে পিছিয়ে পড়ায় জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচকের বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে দেশটির অবস্থান প্রতিবছর নিচে নেমে যাচ্ছে। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ যেখানে এ ক্ষেত্রে ক্রমোন্নতির ধারায় ১২৯ নম্বর অবস্থানে উন্নীত; সেখানে পাকিস্তানের অবস্থান নেমে গেছে ১৬১ নম্বরে। ১৯৪৭-৭১ পর্বে পূর্ববাংলা/পূর্ব পাকিস্তানকে অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ হিসেবে শোষণ, বঞ্চনা, সীমাহীন বৈষম্য ও লুণ্ঠনের অসহায় শিকারে পরিণত করেছিলেন পাকিস্তানের শাসকরা। যার পরিণতিতে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু জিডিপি পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে ৭০ শতাংশ কম ছিল। অথচ ২০১৫ সালেই মাথাপিছু জিডিপিতে বাংলাদেশ পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে। ২০২৪ সালে বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের তুলনাটা দেখুন:
১) মাথাপিছু জিডিপিতে বাংলাদেশ পাকিস্তানের তুলনায় ৬৫ শতাংশ এগিয়ে গেছে। ২) বাংলাদেশের রপ্তানি আয় পাকিস্তানের দ্বিগুণেরও বেশি; ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা ৫৫ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। ৩) বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী ২০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ালেও তা পাকিস্তানের ছয় গুণেরও বেশি। ৪) বাংলাদেশের জনগণের গড় আয়ু ৭৩ বছর; পাকিস্তানে ৬৬। ৫) বাংলাদেশের জনগণের সাক্ষরতার হার ৭৬ শতাংশ, পাকিস্তানের ৫৯ শতাংশ। ৬) বাংলাদেশের মোট জিডিপি ৪৬৫ বিলিয়ন ডলার; পাকিস্তানের ৩৪৬ বিলিয়ন ডলার। ৭) বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ১২ শতাংশ; পাকিস্তানের ২ দশমিক ১ শতাংশ। ফলে পাকিস্তানের জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩ কোটিতে; বাংলাদেশের ১৬ কোটি ৯৮ লাখ। ৮) বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ১১৫ টাকায় এক ডলার পাওয়া যায়; পাকিস্তানে এক ডলার কিনতে ২৯০ রুপি লাগে। অথচ ২০০৭ সাল পর্যন্ত রুপির বৈদেশিক মান টাকার তুলনায় ৮ শতাংশ বেশি ছিল। ৯) বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক ঋণ জিডিপির ২৩ শতাংশ; পাকিস্তানে তা জিডিপির ৪৬ শতাংশ। ১০) বাংলাদেশের নারীদের ৪১ শতাংশ বাড়ির আঙিনার বাইরে কর্মরত; পাকিস্তানে এই অনুপাত মাত্র ১৪ শতাংশ। ১১) বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর হার হাজারে ২১; পাকিস্তানে ৫৯। ১২) বাংলাদেশের শতভাগ জনগণ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। অথচ পাকিস্তানের ৭৩ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ পাচ্ছে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- শিক্ষা গ্রহণ
- পাকিস্তানের রাজনীতি