জ্ঞানচর্চাকে পুঁজিবাদী বিশ্ব ভয় পায়
মানুষের পরাধীনতার কুফল কেবল অর্থনৈতিক তা নয়, মনস্তাত্ত্বিকও। পরাধীন থাকতে থাকতে বাঙালি নিজেকে খুবই ছোট ভেবেছে; তাদের মধ্যে যারা উচ্চমনে ছিল, অর্থাৎ কিনা কাছে ছিল শাসকদের, তারাও হীনম্মন্যতায় ভুগেছে। হীনতার বোধটা মস্তিষ্কে চলে গেছে এবং সেখানে আটকা থাকেনি, থাকার কথাও নয়; পৌঁছে গেছে মেরুদণ্ডেও। এটা যে কেবল বাংলাদেশের ব্যাপারে সত্য, তা নয়। একই ঘটনা উপনিবেশ-শাসিত অন্যান্য দেশেও ঘটেছে।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে একদিন বাংলাই ছিল সামনে। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন কেবল বাংলায় সীমাবদ্ধ থাকেনি, ভারতজুড়ে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের প্রকাশমুখ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু এই আন্দোলনের অর্জনের মধ্যে বাংলার দিক থেকে প্রান্তের দিকে পেছানোর ঘটনাও জড়িত হয়ে গেল। চতুর ইংরেজ বঙ্গভঙ্গ রোধে বাধ্য হলো ঠিকই, কিন্তু ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী আর কলকাতায় রাখল না, সরিয়ে নিয়ে গেল দিল্লিতে। তাদের দিক থেকে কৌশলটা ছিল কলকাতা তথা বাংলার গুরুত্ব কমানোর। কলকাতা থেকে রাজধানী দিল্লিতে চলে যাওয়ায় বাংলার রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব কিছু কমল বৈকি। সে আর ভারতে ব্রিটিশ শাসনের কেন্দ্রে রইল না।
এরপর ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বও চলে গেল অবাঙালিদের হাতে। সর্বভারতীয় রাজনীতির নেতা হিসেবে একদিকে গান্ধী, অপর দিকে জিন্নাহ প্রধান হয়ে দাঁড়ালেন। সাতচল্লিশে যখন দেশভাগ হয়, তখন বাংলার ভাগ্য নির্ধারণের ক্ষমতা বাঙালির হাতে ছিল না, চলে গিয়েছিল সর্বভারতীয় নেতাদের হাতে। দেশভাগের ফলে এক বাংলা দুই বাংলায় পরিণত হয়ে উভয়েই প্রান্তবর্তী হয়ে গেল। পশ্চিমবঙ্গ হারিয়ে গেল ভারতীয় ইউনিয়নে; পূর্ববঙ্গ পূর্ব পাকিস্তানে পরিণত হয়ে পাকিস্তানিদের স্বৈরাচারের অধীনে চলে যেতে বাধ্য হলো।
বাইরের শক্তিগুলো সঙ্গে করে নিজ নিজ ধর্মকেও নিয়ে এসেছিল। এভাবে বাংলায় বৈদিক ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম ও ইসলাম ধর্ম এসেছে; ইংরেজরাও তাদের খ্রিষ্টধর্ম নিয়ে এসেছে, কিন্তু তা গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। তবে ইংরেজ তার শাসনের সুবিধার জন্য ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতাকে উসকানি দিয়েছে। ইংরেজ আসার আগে বাংলায় বিভিন্ন ধর্মের মানুষ পারস্পরিক সম্প্রীতির ভেতর বসবাস করেছে; তাদের ধর্ম আলাদা ছিল, কিন্তু তাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিরোধ ছিল না। সাম্প্রদায়িকতা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ঐক্যকে ভেঙে দিয়েছে এবং স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম শেষ পর্যন্ত পরিণত হয়েছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়। এগোতে গিয়ে আমরা পিছিয়ে গেছি।
শাসকেরা তাদের ভাষাও নিয়ে এসেছে এবং সেটা চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করেছে জনগণের ওপর। এভাবে সংস্কৃত, ফারসি, ইংরেজি রাজদরবারের ভাষা হয়েছে; জনগণের ভাষা বাংলাকে উপেক্ষাই সহ্য করতে হয়েছে। ইংরেজ চলে গেছে, পাকিস্তানিদেরও বিদায় করে দেওয়া গেছে।
কিন্তু তারপরও তো বাংলা ভাষা এখনো প্রান্তেই রয়ে গেছে, কেন্দ্রে উঠে আসতে পারেনি। আদালত, শিক্ষা ও প্রশাসনের উচ্চস্তরে বাংলা চলে না; সমাজের উঁচু উঁচু জায়গায় সে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না; তাকে জায়গা ছেড়ে দিতে হয় ইংরেজি শব্দ, বাক্যাংশ, এমনকি অস্তি আস্ত বাক্যের অশ্লীল অনুপ্রবেশের জন্য।
- ট্যাগ:
- মতামত
- স্বাধীনতা
- জ্ঞান চর্চা
- পুঁজিবাদী