নকশা এবং দুর্বৃত্তায়নের অংশ
এবার শীত খানিক আগেই নেমেছে। গত শুক্রবার ভোর ভোর মনে হলো, হাতের কাছেই ময়মনসিংহ। এক দৌড়ে গ্রামের বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। তিন ঘণ্টার নিঃশ্বাস দূরত্বে উত্তরা থেকে ময়মনসিংহ, দিনে গিয়ে দিনে ঘুরে আসব ভেবে খুশি মনে রওনা দিয়ে কিছুদূর এগিয়েই থমকে যেতে হলো। টঙ্গী পেরিয়েই বাস, ট্রাক, গাড়ির সারি; গিজগিজে ভিড় ঠেলে গাড়ি এগোতে থাকে অতি ধীরে, গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে দুই কিলোমিটার আগে ভোগড়া নামক স্থানে পৌঁছে দেখি আশৈশব পরিচিত ময়মনসিংহ যাওয়ার সোজা রাস্তায় আর যাওয়া যায় না। পশ্চিম দিকে দুই কিলোমিটার ঘুরে নাওজোড় মোড় হয়ে পূর্বদিকে ভাওয়াল কলেজের সামনে দিয়ে গাড়ি এসে আবার ময়মনসিংহ রোডে নেমে সোজা রাস্তায় দাখিল হয়। এক বাক্যে যত সহজে বলা গেল, এই রাস্তায় যান চলাচল এখন ততটাই দুরূহ ও অবিশ্বাস্য শ্লথগতির। কয়েক হাতের বাইপাস রোডে হাজার হাজার বাস-ট্রাক-মোটরগাড়ি– সে এক ধুন্ধুমার পরিস্থিতি! ১০ মিনিটের রাস্তা সাড়ে তিন ঘণ্টায় পেরোতে পেরোতে নানা খবর নেওয়া গেল। জানা গেল, এয়ারপোর্ট থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত বিআরটি প্রকল্পের এই রাস্তা ২০১৮ সালের এপ্রিলে শুরু হয়। প্রকল্প শুরুর সাত বছর পর সরকারি কর্তৃপক্ষের মনে হয়েছে, গাজীপুর ফ্লাইওভারের ইন্টারচেঞ্জ নকশায় ভুল আছে। ভাসমান রাস্তার পরিবর্তে কর্তৃপক্ষ এখন পিলারে মনোযোগী হয়েছে এবং এই কাজে তারা বরাদ্দপ্রাপ্ত চীনা প্রতিষ্ঠানের ওপর ভরসা রাখতে না পেরে বিকল্প কোম্পানির দ্বারস্থ হয়েছে। এখন পিলার বসানোর কাজ চলছে, বলা হয়েছিল– এক মাসের মধ্যেই ভোগড়া বাইপাসের দুর্গতি থেকে রক্ষা পাবেন এই রাস্তায় যাতায়াতকারী লাখ লাখ মানুষ; কিন্তু গত পাঁচ মাসেও যাত্রীদের অবর্ণনীয় নরকবাসের যন্ত্রণা লাঘব হয়নি। আরও জানা গেল, কার্যাদেশ পেতে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের তুলনায় ২৮ শতাংশ কম হারে কাজ করতে রাজি হয়ে চীনা প্রতিষ্ঠান এক পর্যায়ে কাজ চালু রাখতেই হিমশিম খেতে শুরু করে। প্রকল্প চলাকালে নিরাপত্তাজনিত অবহেলায় মোট ৬ বাংলাদেশির মৃত্যু এর অব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়হীনতাকেও স্পষ্ট করে তোলে।
ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে যারা চলাচল করেন, বিগত দেড় দশক তারা রাস্তায় অন্তহীন খোঁড়াখুঁড়ির সঙ্গে পরিচিত। রাস্তায় উন্নয়ন করতে হলে খোঁড়াখুঁড়ির বিকল্প নেই– এটা ন্যূনতম বাস্তবতা, সন্দেহ নেই; তবে আমার কন্যার জন্মমুহূর্ত থেকে যে খোঁড়াখুঁড়ি আমি দেখি টঙ্গী-গাজীপুর পাড়ি দিতে, আঠারো বছরে কন্যা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রার্থী পূর্ণবয়স্ক মানুষ; আর কত পরে আমি নিশ্চিন্তে এই রাস্তা পাড়ি দেব, জানি না।
প্রকল্প শুরুর সাত বছর পর বিআরটি (বাস র্যাপিড ট্রান্সপোর্ট) কর্তৃপক্ষের মনে হয়, রাস্তার নকশায় ভুল আছে। আমাদের আশপাশের সকল কাজে নকশায় ভুলের কথা মনে পড়ে কাজ শুরুর অনেক পরে। এতে ভোগান্তিই শুধু বাড়ে না, নানা ধরনের শক্তির বিপুল অপচয় হয়। কয়েকটি প্রজন্ম অনন্ত হতাশায় নিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের বিতর্কিত দুই জাতীয় নির্বাচনের পর এবারের নির্বাচন নিয়ে নানা ধরনের নকশার কথা জানতে পারি আমরা। এসব নকশা জাতীয় জীবনে ঘোরতর দুর্বিপাক যে নিয়ে আসবে না, তা জোর দিয়ে বলা যাবে না।
গতকাল (সোমবার) সমকালের প্রধান সংবাদ বলছে, ‘নানা কৌশলের পরও জাতীয় নির্বাচনের অর্ধেকসংখ্যক আসনও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করা যাচ্ছে না। প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত হওয়ার পর সারাদেশের ৩০০ আসনের মধ্যে ১০১টিতে লড়াইয়ের আভাস মিলেছে। বাকি আসনের ভোট হতে যাচ্ছে অনেকটাই একতরফা।’ গেল ক’দিনই গণমাধ্যমে প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল আসন ভাগাভাগি প্রসঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ও শরিক ১৪ দলের আলাপ-আলোচনা। এ কোন নির্বাচনী নকশা হচ্ছে দেশে? নির্বাচনের আগে প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রধান দল পরস্পর আসন ভাগাভাগি নিয়ে নিজেরাই আলোচনা করে? এমনই এক বিরোধী দল যে নিজে আমড়াগাছি করে সরকারি দলের কাছ থেকে ২৬ খানা আসন বুঝে নিয়ে নির্বাচনে যাওয়ার মুচলেকা দেয়। এবং সবই প্রকাশ্যে। গণমাধ্যমে। কোথায় সেই বিরোধী দলের ম্যানিফেস্টো– কী করবে তারা সংসদে যেতে পারলে, কিছুই জাতি জানতে পারে না। শুধু জানে, ২৬টি আসনে আওয়ামী লীগ ছাড় দিয়ে দিয়েছে তাদের। সেখানে নৌকা প্রতীক থাকবে না। সরকারি ও বিরোধী দলের এই অবিশ্বাস্য মেলবন্ধন অবশ্য এ দেশে নতুন নয়, পরপর তৃতীয়বারের মতো জাতীয় পার্টি এই অতুলনীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ। এই ভূমিকায় জাতীয় পার্টির নেতারা আখেরে লাভালাভের মুখ দেখলেও দেশের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও কাঠামোর যে করুণ দশা হচ্ছে, তার দায় থেকে সংশ্লিষ্ট কেউই নিজেদের মুক্ত দাবি করতে পারবেন না।
- ট্যাগ:
- মতামত
- নির্মাণ ও সংস্কার কাজ