মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকের সংকটের প্রভাব বিশ্ববিদ্যালয়ে
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ও সাহিত্যিক রায়হান রাইন। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সক্ষমতা, প্রশাসন, ছাত্ররাজনীতি, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ইত্যাদি আলোচিত বিষয় নিয়ে তিনি কথা বলেছেন দেশ রূপান্তরের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের সাঈদ জুবেরী
দেশ রূপান্তর : দেশের প্রাথমিক শিক্ষা ও কারিকুলাম নিয়ে নানা রকম তৎপরতা চলছে। কিন্তু দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলাম নিয়ে তেমন আলাপ দেখি না। কেবল র্যাংকিংয়ে স্থান পাওয়া না পাওয়া নিয়ে কথা ওঠে মাঝে মাঝে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান, পরিবেশ নিয়ে আপনার মন্তব্য কী?
রায়হান রাইন : পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মানোন্নয়নের জন্য এক সময় উচ্চশিক্ষার কৌশলপত্র প্রণয়ন করা হয়েছে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় এবং ইউজিসির মধ্যস্থতায়। এছাড়া হেকেপ এবং আইকিউএসির মতো প্রোগ্রামগুলোও চলেছে। কিন্তু অবস্থার খুব একটা উন্নতি হয়নি। এটা হয়নি কারণ প্রোগ্রামগুলোর গোড়ায় কিছু গলদ আছে। কৌশলপত্রে যেমনটা ছিল তেমনই এই প্রোগ্রামগুলোতেও বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য ধরা হয়েছে শ্রমবাজারের জন্য দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টি করা। যে উদ্দেশ্য নিয়ে প্রাথমিকের কারিকুলামও প্রণয়ন করা হয়েছে। এতে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সঙ্গে সাধারণ ধারাকে সমন্বিত করা হয়েছে। এখানে প্রধান যে সমস্যা সেটা এই যে, এতে জ্ঞান-বিজ্ঞানকে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে দক্ষতা ও পারদর্শিতার সঙ্গে। আশঙ্কার বিষয় এই যে, এই ব্যবস্থার ভেতর দিয়ে যে শিক্ষার্থীরা আগামী দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবে, তারা হয়তো ভর্তি পরীক্ষায় পাসও করবে না, সেজন্য অভিন্ন ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে তোড়জোড় শুরু হয়েছে।
দেশ রূপান্তর : পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গণমাধ্যমে শিরোনাম তো হয় গণরুম, ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায়। পাশাপাশি শিক্ষকদের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোতে আগ্রহের কথাও শোনা যায়।
রায়হান রাইন : পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানের সঙ্গে কারিকুলাম, ক্লাসরুম যেমন জড়িত তেমনই এর সঙ্গে যুক্ত আছে এর ভৌত অবকাঠামো, সাংস্কৃতিক পরিবেশ, আবাসনব্যবস্থা বা হলের পরিবেশ ইত্যাদি নানা কিছু। গণরুম ব্যবস্থার কারণে শিক্ষার্থীদের পড়াশুনা মারাত্মকভাবে বিঘিœত হচ্ছে। ক্লাসরুমের বাইরে বেরিয়ে তারা যে পরিবেশের মুখোমুখি হয়, সেটা মোটেও জ্ঞানচর্চার উপযোগী নয়। যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর সুযোগ পান, সেসব বিশ্ববিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুমগুলোও অনেক ক্ষেত্রে ফাঁকা পড়ে থাকে। অনেক শিক্ষক সপ্তাহে একদিনও ক্লাসে আসতে পারেন না। কেউ কেউ মাসে দু-একবার আসেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান পড়ে যাওয়ার আরেকটি বড় কারণ যথাযথ ভর্তি পরীক্ষার ব্যবস্থা না থাকা। এই বাছাই প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সময় বিভাগভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হতো, তখনকার সঙ্গে বর্তমান শিক্ষার্থীদের তুলনা করলেই মান পড়ে যাওয়ার মাত্রাটা বোঝা যায়। অবশ্য মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের সংকটগুলোর প্রভাবও আছে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে।
দেশ রূপান্তর : পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি তাদের স্বায়ত্তশাসনের চর্চা করতে পারছে? না পারলে কেন?
রায়হান রাইন : পাবলিক বিশ্ববিদ্যলয়গুলোতে কিছু মাত্রায় স্বায়ত্তশাসন আছে অবশ্যই। কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়, তাতে পুরো প্রশাসন সরকারের নিয়ন্ত্রণের ভেতর চলে যায়। তাদেরই উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় যারা আনুগত্যের দৌড়ে এগিয়ে থাকেন। উচ্চশিক্ষার কৌশলপত্র এই স্বায়ত্তশাসনকে প্রায় নাকচ করে দিয়েছে। এতে ইউজিসির ক্ষমতা বাড়িয়ে একে উচ্চ শিক্ষা কমিশন হিসেবে গড়ে তোলার প্রস্তাব আছে এবং এটি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে সব রকম নিয়োগ এবং নীতিনির্ধারণী ক্ষমতা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতছাড়া হয়ে যাবে।