আসন্ন নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে
তা বছর পঁচিশ আগে হবে, এক তরুণ আমাকে তার একটি দুঃসাহসী প্রত্যাশার কথা বলেছিল। সেটি এই যে, নির্বাচনে দুটি বিষয়কে ইস্যু হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। একটি হচ্ছে ধর্ম, অপরটি মুক্তিযুদ্ধ। তখনকার পরিস্থিতিতে চিন্তাটা দুঃসাহসী ছিল বৈ কি। কারণ, তখন আওয়ামী লীগ বলছিল, তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি। বিএনপি ভাব করছিল যে তারা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের পক্ষে; যে জাতীয়তাবাদ বাঙালি জাতীয়তাদের ধর্মনিরপেক্ষতাকে নাকচ করে দেয় বলে তারা ভাবত। ওই তরুণের এখন বয়স বেড়েছে নিশ্চয়ই এবং এখন হয়তো সে স্বস্তি পেয়েছে এটি দেখে যে, এবারের নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্ম কোনোটাই ব্যবহৃত হবে না বলে সবার ধারণা। এটি কোনো আদর্শগত বিপ্লবের কারণে ঘটেনি। ঘটেছে অবস্থার কারণে। বস্তুত অবস্থা আদর্শকে পেছনে ঠেলে দিয়েছে। তাই দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগের আস্থা যে বাঙালি জাতীয়তাবাদে, তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের অত্যন্ত উৎসাহী প্রবক্তা, এক সময়ে যিনি বিএনপির মহাসচিব ছিলেন এবং দলের রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত হয়েছিলেন, তিনি যোগ দিয়েছিলেন আওয়ামী জোটে। আবার রাষ্ট্রধর্মের প্রবর্তক প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও আওয়ামী জোট থেকেই নির্বাচন করেছিলেন। এর বিপরীত দিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদে গভীর আস্থা রেখে যারা রাজনীতি করতেন এবং বিশিষ্ট অবস্থানেই ছিলেন, তাদের কেউ কেউ যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী বিএনপির জোটে। বোঝা যাচ্ছে, প্রয়োজনে আদর্শ বদলানো যায়, বিশেষ করে যদি সম্ভাবনা থাকে ক্ষমতা লাভের।
তবে এটি আমাদের স্মরণ রাখা আবশ্যক যে, রাজনীতিতে ধর্ম ও মুক্তিযুদ্ধ দুটি প্রশ্নের মীমাংসা এরই মধ্যে হয়ে গেছে। বস্তুত মীমাংসা করেই রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা। ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও আচরণের ব্যাপার। রাষ্ট্রের তাতে কিছু করার নেই। রাজনীতির সঙ্গে ধর্মকে মেলানো যাবে না– এই সিদ্ধান্তে আমরা মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে পৌঁছেছি। ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে পরিত্যাগ করে তবেই না বাংলাদেশের অভ্যুদয়। ওই ব্যাপার নিয়ে আবার বিতর্ক তাহলে তোলা হয়েছিল কেন? কারণটা তো আমরা জানি। কারণ হচ্ছে নির্বাচনে জেতার মতলব। সে মতলব হাসিলে দুই দলই ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে অবিরাম তোয়াজ করেছে; এখনও করছে।
একইভাবে মুক্তিযুদ্ধ ও তার চেতনাও কোনো অমীমাংসিত বিষয় নয়। মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তিতেই এ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তাই কোনো রায়ের দরকার নেই; আবশ্যকতা নেই গণভোটের। ধরেই নিতে হবে, অল্পকিছু রাষ্ট্রদ্রোহী ছাড়া এ দেশের সব নাগরিকই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। মুক্তিযুদ্ধকে নির্বাচনের ইস্যুতে পরিণত করা হলে রাষ্ট্রদ্রোহীদের বরং সুবিধা করে দেওয়া হয়। আরও বড় বিপদ ছিল এই যে, রাজনৈতিক দলবিশেষের সাফল্য-ব্যর্থতার দায়ভার গিয়ে চেপে বসবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর। দলের সেই দায়ভার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিজের কাঁধে নেবে কেন? কোন অপরাধে?
দেখতে পাচ্ছি, আসন্ন নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্ম তেমন ব্যবহৃত হচ্ছে না। কারণ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি দু’দিকেই আছে এবং ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহারের উৎসাহীরাও যে কোনো একটি মাত্র শিবিরে জমায়েত হয়েছে, তা মোটেই নয়; তাদের দুই জোটেই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। তবে নির্বাচনী বক্তব্য তো লাগবে, না হলে কোন কথা বলে ভোট চাওয়া যাবে? আওয়ামী জোট তাই বলছে তাদের শাসনামলের উন্নয়নের কথা। অপর পক্ষ আওয়াজ তুলেছে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের। তা যে কারণেই হোক, মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মকে ভোটে জেতার কাজে লাগানোতে যে সুবিধা হচ্ছে না, সেটি একটি শুভ লক্ষণ বটে। ধর্ম নিয়ে রাজনৈতিক ব্যবসাটা নতুন ঘটনা নয়, পুরোনো ব্যাপার বটে। ব্রিটিশ আমল এবং পাকিস্তানি জামানায় ওই ব্যবস্থা ভালো জমেছিল। তাতে ভীষণ ক্ষতি হয়েছে দেশের মানুষের। ধর্মকে উচ্চে তুলে ধরে মানুষের খাওয়া-পরা, বেঁচে থাকার সংকট সম্পর্কে অন্যমনস্ক করে দেওয়া হয়েছিল। ওই ঐতিহ্য এখনও শেষ হয়নি।